Thursday | 23 October 2025 | Reg No- 06
Epaper | English
   
English | Thursday | 23 October 2025 | Epaper
BREAKING: সাইফ ও সৌম্যর রেকর্ড জুটিতে ২৯৭ রানের লক্ষ‍্য দিল বাংলাদেশ      দেশকে এগিয়ে নিতে নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন: মির্জা ফখরুল      টস জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ      সহজেই জয় পেল অস্ট্রেলিয়া      ইসরায়েলের পার্লামেন্টে পশ্চিম তীর দখলের বিল পাস      জেনেভা ক্যাম্পে দু'গ্রুপের সংঘর্ষে যুবক নিহত      কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি জামায়াতের, জানালেন প্রধান উপদেষ্টাকে      

রাস্তা পাকা, পেট ফাঁকা: উন্নয়ন কি মানুষের জীবনমান বদলাচ্ছে?

Published : Wednesday, 20 August, 2025 at 12:57 PM  Count : 155

“অট্টালিকা উঠছে, খেতে পাচ্ছে না শ্রমজীবী মানুষ।”

দ্যুতিময় অট্টালিকা যেন দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দ এক ব্যঙ্গের মতো। কংক্রিট, ইট, পাথরের স্তূপ আকাশ ছুঁতে থাকে, অথচ তার ছায়াতেই পেটের ক্ষুধায় কুঁকড়ে যায় অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ। উন্নয়নের গল্প দেশের টেলিভিশনের পর্দায় ঝলমল করে, মন্ত্রীর বক্তৃতায় ম্লান হয় না, প্রকল্প উদ্বোধনের কোলাহলে ধরা পড়ে; কিন্তু ভোরবেলায় রাস্তার ধুলায় ঘাম ঝরানো সেই মানুষের হাঁড়ি-পাতিতে জমে থাকে নিঃসঙ্গতা।

উন্নয়নের পরিসংখ্যানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনের অঙ্ক মেলেনা। যখন বলা হয়—প্রবৃদ্ধি ৭, ৮ বা ৯ শতাংশ, তখনও গ্রামের কোনো শ্রমিকের ঘরে শিশুটি আধপেটা খেয়ে স্কুলে যায়, কোনো গার্মেন্টস কর্মী অর্ধেক বেতনের বোঝা নিয়ে জীবনযাপন করে। রাজধানীর চকচকে সড়ক ধরে ছুটে চলা গাড়ির পাশে বসা ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকের দৃষ্টি যেন পুরো জাতির বিবেককে প্রশ্ন করছে—“এই উন্নয়ন আসলে কার জন্য?”

অট্টালিকার জানালায় ঝলমলে আলো জ্বলে, অথচ শ্রমজীবী মানুষের ঘরে জ্বলে কেরোসিনের ক্ষীণ প্রদীপ, সেটাও যদি ভাগ্যে জোটে। শহরে ফ্লাইওভার উঠছে, গ্রামীণ হাসপাতালে কোনো মা তার অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে ওষুধ না পেয়ে ফিরে আসে। বিলিয়ন ডলারের মেগা প্রজেক্ট উদ্বোধনে করতালির ঝড় ওঠে, অথচ হাজারো পরিবার দিনশেষে ভাঙা প্লেটে শুকনো ভাত ভিজিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

সবচেয়ে বেদনাদায়ক হলো—এই বৈপরীত্যকে আমরা স্বাভাবিক করে ফেলেছি। অট্টালিকার ভেতরে সুখী মানুষের উল্লাস, বাইরে ক্ষুধার্ত মানুষের দীর্ঘশ্বাস—একই শহরে একসাথে চলতে থাকে। উন্নয়নের ঝলকানিতে ঢাকা পড়ে যায় সেই মুখগুলো, যাদের ঘামে এই উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে উঠেছে।

শ্রমিক যখন ইট টেনে নেয় মাথায়, দিনমজুর যখন গরম রোদে মাটি খুঁড়ে, তখনই কংক্রিটের স্বপ্ন তৈরি হয়। অথচ সেই স্বপ্নের ভেতরে তাদের জন্য কোনো ঘর থাকে না। অট্টালিকা তাদের শ্রমে উঠে, কিন্তু দরজা খোলে না। তারা কেবল দেয়াল তোলে, দেয়ালের ভেতরে প্রবেশাধিকার তাদের নেই।

গ্রামের কৃষক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে কাজ করেন, কিন্তু ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না। শহরের শ্রমিক দীর্ঘক্ষণ কারখানায় ঘাম ঝরাচ্ছেন, তবুও মজুরি দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। তরুণরা চাকরির অভাবে বিদেশমুখী হচ্ছেন কখনো বা বেকার থেকে পরিবার-পরিজনের বোঝা হয়ে যাচ্ছেন। সমাজের অসহায় মানুষ ঠিকভাবে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না; দুবেলা ঠিক মতো খাবারও মেলে না। অথচ আমরা উন্নয়নের গল্প শোনাই। শহরের বিশাল স্থাপনার পাশেই ঝুপড়ি বা কুঁড়ে ঘরে স্বপ্ন হারাচ্ছে বস্তিবাসী। ধনীর অট্টালিকার নিচেই গরিবরা বৈষম্যের শিকার। এই ধনী–দরিদ্র বৈষম্য না কমলে উন্নয়ন কোন কাজে আসবে না।

[অবকাঠামোর ঝলকানি মানুষের মৌলিক চাহিদা ঢাকতে পারছে না। মানুষের পেটে ভাত নেই, চুলায় আগুন নেই। দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ নাভিশ্বাস করছে, অথচ চারপাশে ঝকঝকে রাস্তা, সেতু ও কংক্রিটের অট্টালিকা। প্রশ্ন জাগে—এই উন্নয়ন কি সত্যিই মানুষের জীবন বদলাচ্ছে, নাকি কেবল দৃশ্যমান চিত্র পরিবর্তন করছে? যদি রাষ্ট্রের উন্নয়ন মানুষের খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত না হয়, তবে এটি কেবল “মায়াজাল” ছাড়া কিছু নয়। প্রকৃত উন্নয়ন হলো মানুষের কল্যাণে প্রতিফলিত হওয়া—যেখানে প্রত্যেক মানুষ পেট ভরা, স্বাস্থ্য সুরক্ষিত, শিক্ষা অর্জন করতে পারে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। ধনী–দরিদ্রের বৈষম্য সেখানে থাকবে না।]

বাংলাদেশের উন্নয়ন আজ অনেকাংশে অবকাঠামো নির্ভর। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। রাজধানীতে মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার ও আধুনিক মহাসড়ক মানুষের চলাচল সহজ করেছে। শহরে আধুনিক রেস্টুরেন্ট, শপিংমল ও হোটেল—সব মিলিয়ে “আলোকোজ্জ্বল বাংলাদেশ”। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের জীবনমানের সঙ্গে কতটা সমন্বিত? গ্রামে পাকা রাস্তা হলেও কৃষকের ধান ন্যায্যমূল্যে বিক্রি হচ্ছে না। শহরে মেট্রোরেল চললেও শ্রমজীবী মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনের ওপর নির্ভর করছে। অবকাঠামো উন্নয়ন দরকার, কিন্তু মানুষের মৌলিক জীবনযাত্রার মান বাড়ানোই প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত।

উন্নয়ন শুধু রাস্তা ও সেতু নয়; মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশের গ্রামে অনেক পরিবার দিনে তিন বেলা খাবার নিশ্চিত করতে পারছে না। শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ভয়াবহ। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি অনুযায়ী, প্রায় ৩০% শিশু এখনও অপুষ্টির শিকার।

কর্মসংস্থানের সংকটও তীব্র। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো অনুসারে যুব বেকারত্ব সাধারণ বেকারত্বের দ্বিগুণ। দিনমজুর ও গার্মেন্টস শ্রমিক মাসে ১০–১২ হাজার টাকায় সংসার চালাচ্ছেন, যা শহরের জীবনধারণের খরচের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উন্নয়নের প্রকৃত মান তখনই বোঝা যায়, যখন মানুষের পেট ভরা, সন্তানরা শিক্ষিত, পরিবার নিরাপদ এবং কর্মসংস্থান নিশ্চিত। কেবল অবকাঠামো ঝলকানি এই বাস্তবতা ঢাকতে পারছে না।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও বৈষম্য: শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়নের মূল স্তম্ভ। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বৈষম্য স্পষ্ট। ধনী পরিবার তাদের সন্তানকে ভালো স্কুলে পাঠাতে পারে, গরিব পরিবার ন্যূনতম শিক্ষাই পাচ্ছে না। শিক্ষার মানের ঘাটতি বাজারের চাহিদার সঙ্গে মিলছে না, ফলে শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ছে।

স্বাস্থ্যক্ষেত্রে শহরের হাসপাতালগুলো উন্নত, গ্রামে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এখনও সীমিত। প্রতি বছর প্রায় ৬৭ লাখ মানুষ চিকিৎসা খরচ জোগাতে গিয়ে দরিদ্র হয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বৈষম্য দেশের প্রকৃত উন্নয়নকে সীমিত করছে।

গ্রামীণ বাস্তবতা বনাম শহরের চাকচিক্য: শহরের আধুনিকায়ন চোখে পড়লেও গ্রামে মানুষের জীবন কঠিন। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নেই, শ্রমিকদের জীবন নিরাপদ নয়। শহরের উন্নয়ন গ্রামীণ মানুষের কাছে প্রায়শই দূরের খেয়াল মাত্র। শহর ও গ্রামের এই বৈপরীত্য সামাজিক বৈষম্যের প্রতিফলন।

সংখ্যার ফাঁদ: জিডিপি বনাম মানব উন্নয়ন সূচক

বাংলাদেশের অর্থনীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে—জিডিপি বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের আয় সমান হারে বাড়ছে না। দেশের ধনী ১০% সম্পদের বড় অংশ দখল করছে, নিম্ন ৪০% মানুষ সীমিত আয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। মানব উন্নয়ন সূচক (HDI) অনুযায়ী, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আয়ে সমতা এখনও অপর্যাপ্ত। জিডিপি বৃদ্ধি হলেও মানুষের মৌলিক জীবনমানের উন্নতি তত দ্রুত হচ্ছে না। প্রকৃত উন্নয়ন হলো—পেট ভরা, শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত, যুবকেরা কর্মসংস্থানে যুক্ত।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, “উন্নয়ন হলো মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।” শুধুমাত্র অবকাঠামো যথেষ্ট নয়। অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, “রাস্তা, সেতু বা বড় প্রকল্প দেখানোর চেয়ে মানুষের জীবনমান উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।” গ্রামের মানুষ ও শ্রমজীবী এখনও প্রকৃত উন্নয়নের বাইরে। এই মতামত স্পষ্ট করে—মানুষকেন্দ্রিক নীতি ছাড়া উন্নয়ন অসম্পূর্ণ।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও তুলনা: ভুটান “গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস” সূচকের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া ১৯৬০–৭০ দশকে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসেবা প্রসারের মাধ্যমে উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের উদাহরণ—গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্প, মহিলা কর্মসংস্থান কর্মসূচি—মানুষকেন্দ্রিক উদ্যোগের সুফল দেখিয়েছে। বিশ্বের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে—উন্নয়ন কেবল অবকাঠামো নয়, মানুষের ক্ষমতা ও সুযোগ সম্প্রসারণে কাজ করতে হবে।

টেকসই উন্নয়নের জন্য করণীয়: মানুষকেন্দ্রিক বাজেট।কৃষক ও প্রান্তিক মানুষের সুরক্ষা।ন্যায্য মজুরি ও শ্রম সুরক্ষা। শিক্ষার মানোন্নয়ন। স্বাস্থ্যসেবা প্রসার।উন্নয়ন সূচকের নতুন সংজ্ঞা। ধনী–দরিদ্র বৈষম্য হ্রাস।

এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন কেবল রাস্তা–সেতু নয়, মানুষের জীবনমানেও দৃঢ়ভাবে প্রতিফলিত হবে।

পরিশেষে বলতে হয়—মানুষকেন্দ্রিক উন্নয়নই সত্যিকার উন্নয়ন। রাস্তা, সেতু বা ভবন—সবই প্রয়োজন। কিন্তু মানুষের হাসি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা এবং মর্যাদা ছাড়া উন্নয়ন কেবল সংখ্যার খেলা। প্রকৃত উন্নয়ন তখনই অর্জিত হবে, যখন প্রতিটি মানুষের পেট ভরা, সন্তান শিক্ষিত, পরিবার নিরাপদ, শ্রমিক ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন তখনই সম্পূর্ণ হবে, যখন অবকাঠামো উন্নয়ন ও মানুষের জীবনমান সমানভাবে এগোবে। মানুষের কল্যাণ, মৌলিক অধিকার এবং সামাজিক সমতা নিশ্চিত করাই প্রকৃত উন্নয়নের মানদণ্ড।

মো: মাজেম আলী মলিন,
সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ;
রোজী মোজাম্মেল মহিলা অনার্স কলেজ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

আরএন


LATEST NEWS
MOST READ
Also read
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000.
Phone: PABX- 41053001-06; Online: 41053014; Advertisement: 41053012.
E-mail: [email protected], news©dailyobserverbd.com, advertisement©dailyobserverbd.com, For Online Edition: mailobserverbd©gmail.com
🔝
close