একটি উন্নত জীবনের আশায় ঘরবাড়ি, জমিজমা বিক্রি করে কিংবা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি প্রতিবছর পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই)। কেউ যান পরিবারের স্বপ্ন পূরণে, কেউ যান সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরের (১ জুলাই ২০২৪ থেকে ৩০ জুন ২০২৫) পরিসংখ্যান যেন এই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেয়। এই এক বছরে ৭২৪ জন প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন শুধু লাশ হয়ে।
এই মৃত্যুর মিছিলের সবচেয়ে বড় কারণ হৃদরোগ বা স্ট্রোক। আবুধাবি ও দুবাইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশি কনস্যুলেট ও দূতাবাস সূত্র জানায়, ৭২৪ জনের মধ্যে ৫৬৫ জনের মৃত্যু হৃদরোগে, ৪৮ জন সড়ক দুর্ঘটনায়, ১৯ জন কর্মস্থলে দুর্ঘটনায়, ৩২ জন আত্মহত্যায় এবং ৬১ জন অন্যান্য কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন।
কেন এতো মৃত্যু?
প্রথমত, ইউএই-তে প্রবাসীদের কাজ করার পরিবেশ অত্যন্ত কঠিন ও শ্রমঘন। অনেকেই প্রতিদিন ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করেন, যার ফলে তাদের শরীর পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায় না। দীর্ঘসময় তীব্র গরমে বাইরে কাজ করা, সঠিক খাদ্যাভ্যাসের অভাব, পর্যাপ্ত পানি না পান করা এবং ঘুমের অনিয়ম, সবমিলিয়ে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, মানসিক চাপ। যারা বৈধ ভিসায় এসেছেন তাদের অনেকেরই কাজ মেলে না, আবার যারা অবৈধ হয়ে পড়েছেন তাদের কাজের সুযোগ একেবারে সীমিত। আয় না থাকায় তাদের অনেককে পরিবার থেকেই টাকা আনতে হয়, যা তাদের মানসিকভাবে ভেঙে ফেলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবারের চাহিদা, কিস্তির টাকা, সন্তানদের ভবিষ্যতের চিন্তা এক অব্যক্ত চাপ। এই চাপই ধীরে ধীরে শরীরকে করে তোলে অসুস্থ, আর শেষমেশ একটি হৃদরোগে থেমে যায় জীবন।
স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতার অভাব
বাংলাদেশি শ্রমিকদের বড় একটি অংশের বয়স ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। এ বয়সে নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি হলেও, অধিকাংশেরই সে সুযোগ থাকে না। বহু প্রবাসী জানেন না যে তারা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ কিংবা উচ্চ কোলেস্টেরোলে ভুগছেন। এসব অসুখ চুপিসারে শরীরের ক্ষতি করতে করতে একদিন হৃদরোগে মৃত্যু ঘটায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশি প্রবাসীদের খাদ্যাভ্যাসেও রয়েছে বড় ধরণের ঘাটতি। অধিকাংশ সময় রান্না করা খাবার পাওয়া যায় না; ফাস্টফুড, তেল-চর্বিযুক্ত খাবারেই ভরসা করতে হয়। ফলমূল ও শাকসবজি গ্রহণের প্রবণতা খুব কম। ধূমপান ও অ্যালকোহলের ব্যবহার, শারীরিক অনুশীলনের অভাব সব মিলিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
আত্মহত্যা: আরেক ভয়াবহ বাস্তবতা
এক বছরে ৩২ জন বাংলাদেশি আত্মহত্যা করেছেন আমিরাতে। এটি কোনো সংখ্যার খেলা নয়, বরং গভীর সামাজিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি এখনো আমাদের সমাজে অবহেলিত। প্রবাসীরা একা থাকেন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন এবং কারো সঙ্গে খোলামেলা কথা বলার সুযোগ পান না। হতাশা, অবসাদ, একাকিত্ব এসব যখন মিলে যায়, তখন অনেকেই চূড়ান্ত পথ বেছে নেন।
রাষ্ট্রের করণীয় কোথায়?
প্রতিবছর প্রবাসীরা বাংলাদেশে পাঠান প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রার উৎস। অথচ এই মানুষগুলোর জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক পরামর্শ, দূতাবাসে জরুরি সহায়তা বা শ্রমিক কল্যাণে দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রকল্প দৃশ্যমান নয়। ইউএইতে বাংলাদেশের প্রায় ১২ লাখ প্রবাসী থাকলেও দূতাবাস ও কনস্যুলেটে জনবল ও সেবার অভাব রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। প্রবাসীরা শুধু রেমিটেন্স পাঠান না, তারা নিজের জীবন দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখেন। তাদের মৃত্যু শুধু এক পরিবারের কান্না নয়; এটি আমাদের ব্যর্থতা, আমাদের পরিকল্পনার অভাবের প্রতিচ্ছবি।
সমাধান কী?
ছয় মাস পরপর স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
প্রবাসীদের জন্য ‘মোবাইল মেডিকেল ক্যাম্প’ চালু করা।
মেডিকেল ইনস্যুরেন্স নিশ্চিত করা।
দূতাবাসে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্র চালু করা।
প্রবাসী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে স্বাস্থ্য ও মানসিক সচেতনতা যুক্ত করা।
অবৈধ অভিবাসন রোধে শক্ত অবস্থান ও দেশে ফেরা প্রক্রিয়া সহজ করা।
প্রতিটি মৃত্যু শুধু একটি সংখ্যা নয়, একটি পরিবার, একটি স্বপ্ন, একটি সমাজের করুণ ভাঙন। প্রবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের যত্ন বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। শুধু রেমিটেন্স নয়, মানুষটাই আমাদের আসল সম্পদ তাকে মর্যাদা না দিলে, তার স্বপ্নগুলো কেবল কফিনেই বন্দি হবে।
লেখক : সভাপতি প্রবাসী সাংবাদিক সমিতি (প্রসাস), ইউএই।