Wednesday | 26 November 2025 | Reg No- 06
Epaper | English
   
English | Wednesday | 26 November 2025 | Epaper
BREAKING: কড়াইল বস্তিতে আগুন: পানি সংকটে নিয়ন্ত্রণে বেগ      কড়াইল বস্তিতে আগুন      উপদেষ্টা পরিষদে গণভোট অধ্যাদেশ অনুমোদন      বগুড়ায় দুই শিশু ও মায়ের মরদেহ উদ্ধার      প্লট বরাদ্দে দুর্নীতি: হাসিনা-রেহানা-টিউলিপের মামলার রায় ১ ডিসেম্বর      মেট্রোরেলে চালু হলো ঘরে বসে অনলাইন রিচার্জ      ভালো নির্বাচনের জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন: সিইসি      

শ্রমিকের হাটেও বৈষম্যের শিকার নারী

Published : Monday, 24 November, 2025 at 1:42 PM  Count : 69

অরুণোদয়ের আগমনী আলো তখনও দিগন্ত ছুঁয়ে ওঠেনি। কুয়াশার সাদা চাদরের নিচে দাঁড়িয়ে আছে কিছু ছায়া- কারও মাথায় জীর্ণ কাপরের ওড়না, কারও হাতে নিড়ানি, কেউবা আবার কাস্তে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে আছে জীবনের মতোই কঠিন নিশ্চুপতায়। তারা উচ্চ পেশার কেউ নয়- তারা হলো আমাদের দেশের হাজারো সংগ্রামী নারী শ্রমিক, যাদের ভোরের আগে জেগে ওঠে শুধু নিজের ক্ষুধা আর পরিবারের বোঝা বয়ে নিতে।

ট্রাকের ধাক্কাধাক্কি, করিমনের কর্কশ শব্দ, লসিমনের ধুলোমাখা দপদপে ইঞ্জিন- সবকিছুর মাঝেও তারা দাঁড়িয়ে থাকে স্থির, পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল তাদের একটুও টলাতে পারে না। পুরুষের ভিড়ের মাঝে তারা যেন অচেনা সাহসের নীরব প্রতিমা- কাজের সন্ধানে, দিনের মজুরির আশায়, বাঁচার অপরিহার্য যুদ্ধ নিয়ে।

শুধু শ্রমিকের হাট নয়- এ যেন জীবনের নির্মম দর-কষাকষির একটা জীবন্ত মঞ্চ। যেখানে নারীর ঘাম শুকানোর আগে মজুরি শুকায় না কখনোই। একই কাজ, একই রোদ, একই ক্লান্তি- তবু মজুরির নামে বৈষম্যের দেয়াল তাদের সামনে প্রতিদিন আরও উঁচু প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়।

এই হাটে দাঁড়িয়ে নারী শ্রমিকরা শুধু শ্রম বিক্রি করেন না- তারা বিক্রি করেন স্বপ্নের টুকরো, শরীরের শক্তি, আর না বলা অসংখ্য বেদনার গল্প। যে গল্পগুলো আমরা দেখি না, শুনি না, আর বুঝতে চাই না। কিন্তু প্রতিটি সূর্যোদয়ের আগে, কুয়াশা ভেদ করে উঠে আসে সেই গল্পগুলোরই নীরব বেদনা 'আমরা কি সত্যিই সমান?'। 

বলছি চলনবিল অধ্যুষিত নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নয়াবাজার শ্রমিকের হাটে আশা নারী শ্রমিকদের দুঃস্বপ্নের কথা। 

ভোর ৫টা থেকেই শ্রমিকদের পদচারণার জমে উঠে এই হাটটি। এখানে আসে নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। ধান কাটা, রসুন রোপণ, চারারোপণ- সবই তাদের কাজ। কিন্তু এই শ্রমিকের হাটের সাথে জড়িয়ে আছে কষ্ট, দারিদ্র্য আর বৈষম্যের করুণ ছায়া।

নবনিতা ওরাঁও (৪৫) সিরাজগঞ্জের মেরিগাছা গ্রাম থেকে ট্রাকে করে এসেছেন এই হাটে। তার হাতের তালুতে কাদা আর চোখে ক্লান্তি। 'কুড়ি টাকা ভাড়া দিয়ে এসেছি, কিন্তু ন্যায্য মজুরি পাই না,' বলে তার কণ্ঠে ভেসে আসে জীবনের ক্লান্তি। তার কাহিনী শুধু তার নয়, বরং হাজারো নারী শ্রমিকের প্রতিদিনের সংগ্রামের গল্প। 

পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা পাবনার আতাইকুলা থেকে আসা কলি বেগম (৫০) বলেন, 'আমাদের এলাকায় এখন কাজের মৌসুম নেই। তাই গুরুদাসপুরে এসে ধান কাটাসহ সব ধরনের কাজ করি। জীবন তো আর থেমে থাকে না, তাই আমরা বাঁচতে এসেছি এখানে।'

কৃষি শ্রমিক মায়া টক্কি যোগ করেন, 'সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আমরা নিরবচ্ছিন্ন শ্রম দেই। মজুরি পাই ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। অথচ পুরুষরা একই কাজের জন্য পান ৫৫০-৬০০ টাকা। দারিদ্রের চাপে বৈষম্য মেনে নিয়েই বাধ্য হয়ে কাজ করি আর জীবন চালাই।'

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী শ্রমিক শোভা রানী বলেন, 'দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এই সামান্য মজুরি দিয়ে ছেলে-মেয়ে আর বৃদ্ধ বাবা-মাসহ ৮ সদস্যের সংসার চালানো খুবই কঠিন। তারপরও কাজ করতে হয়। কাজ না করলে বাঁচবো কিভাবে?'

দিনমজুরদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বোঝা যায়, কম মজুরিতে শ্রম বিক্রি করা হলেও তাদের জন্য এটি বেঁচে থাকার একমাত্র পথ। 

স্থানীয় কৃষকরা জানান, কঠোর পরিশ্রমী, সহজ-সরল এবং কম মজুরিতে শ্রম দেওয়ার কারণে নারী শ্রমিকদের চাহিদা বেশি।

শ্রমিকদের এই ভোরের চিত্র আরও বেশি স্পষ্ট হয় যখন তারা দল বেধে ট্রাকের ছাদ, নছিমন বা অটোভ্যানে করে আসেন। সকলের গায়ে শীতের জীর্ণ মলিন পোশাক, হাতে কাজের উপকরণ। কৃষকরা দর দাম মিটিয়ে সরাসরি ভ্যানযোগে নিয়ে যান মাঠে। 

কৃষক আলম মোল্লা বলেন, ধান কাটা, বিনা হালে রসুন রোপণ, ধানের খড় বিছানোসহ জমি তৈরির সব কাজ এই শ্রমিকদের দিয়ে করানো হয়। 

তাহের প্রামাণিক বলেন, প্রতিদিন সকালে এই হাট থেকে শ্রমিক ক্রয় করে নিয়ে যাই। স্থানীয় শ্রমিকের সংখ্যা কম থাকলেও এই নয়াবাজার শ্রমিকের হাটের কল্যাণে সহজেই শ্রমিক পাওয়া যায়।

ধারাবারিষা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবদুল মতিন বলেন, 'বনপাড়া‑হাটিকুমরুল মহাসড়ক চালুর পর থেকে প্রায় দুই যুগ ধরে নয়াবাজার পয়েন্টে শ্রমিক হাট বসছে। চলনবিলের প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় ধান কাটাসহ রসুন রোপণের সময় এখানে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ হাজার শ্রমিক জমায়েত হয়। সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক আসে এই হাটে , যারা কম মজুরিতে কাজ করতে রাজি হয়।'

নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাবিবুল ইসলাম খান বলেন, 'নারী শ্রমিকরা পুরুষের সমান কাজ করেও সবচেয়ে কম মজুরি পান। অনেক সময় তারা গ্রাম্য মহাজন এবং স্থানীয় এনজিও থেকে উচ্চ সুদে অগ্রিম টাকা নিতে বাধ্য হন, ফলে কম মজুরিতে শ্রম বিক্রি ছাড়া তাদের আর উপায় থাকে না।'

শ্রমিক হাটের এ নারী শ্রমিকরা তাদের ঘাম ঝরিয়ে প্রতিটি ধান ক্ষেত, রসুন ক্ষেত ও চারা রোপণ মাঠে শ্রম দিচ্ছেন কিন্তু বৈষম্যের ছায়া এখনও তাদের জীবনকে ঢেকে রেখেছে। শ্রমিক হাটের এই নারী শ্রমিকরা দিনের পর দিন ধান ক্ষেতে, রসুন ক্ষেতে, চারা রোপণের কাঁদামাটিতে নিজের ঘাম মিশিয়ে কৃষির চাকা চলমান রাখেন। অথচ অন্যায়ের এক অদৃশ্য কুয়াশা এখনও তাদের জীবনকে ঢেকে রেখেছে। শীতের কাঁপণ, ভোরের শিশির আর জমাট বাধা কুয়াশা ভেদ করে দাঁড়িয়ে থাকা এসব শ্রমজীবী নারীর চোখে থাকে একটাই আকুতি 'আমরা বাঁচতে চাই, আমাদের শ্রমের ন্যায্য দাম চাই।'

এই আর্তনাদ শুধু টিকে থাকার সংগ্রাম নয়, এটি বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক নীরব বিদ্রোহ, সমাজের বিবেককে বার বার প্রশ্ন করা এক মর্মস্পর্শী বেদনা। দেশের কৃষি জমি উর্বর হয় তাদের হাতের মমতা, ঘামে ভেজা পরিশ্রমে- কিন্তু তাদের প্রাপ্য মূল্য ও সম্মান এখনও কাগুজে প্রতিশ্রুতির বাইরে রয়ে গেছে। প্রতিটি ভোর, প্রতিটি শ্রমিকের নিঃশব্দ পদচারণা যেন আমাদের কানে ফিসফিস করে বলে- নারীর শ্রম আজও বৈষম্যের কঠিন পাথরে চূর্ণ।

তবুও তারা থেমে যান না। কারণ তারা জানেন, তাদের শ্রমেই দেশের অন্নের শিকড়। এই নারীদের নীরব কান্না শুধু তাদের নয়- এটি পুরো সমাজের বিবেককে জাগিয়ে তোলার এক শেষ সতর্কবাণী। ন্যায্য মজুরি তাদের অধিকার- এটি আর বিলম্ব নয়, আজই নিশ্চিত করার সময়।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান সমাজবিজ্ঞান বিভাগ রোজী মোজাম্মেল মহিলা অনার্স কলেজ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট ডেইদহ অবজারভার।

এমএ


LATEST NEWS
MOST READ
Also read
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000.
Phone: PABX- 41053001-06; Online: 41053014; Advertisement: 41053012.
E-mail: [email protected], news©dailyobserverbd.com, advertisement©dailyobserverbd.com, For Online Edition: mailobserverbd©gmail.com
🔝
close