Saturday | 25 October 2025 | Reg No- 06
Epaper | English
   
English | Saturday | 25 October 2025 | Epaper
BREAKING: শাহবাগে এনসিপির দুই পক্ষের সংঘর্ষ      টেকনাফে পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে নারী-শিশুসহ উদ্ধার ৪৪      কক্সবাজার বিমানবন্দরের ‘আন্তর্জাতিক’ স্বীকৃতি স্থগিত      যমুনা রেল সেতুর পিলারে ফাটল: কর্তৃপক্ষ বলছেন গুজব      নভেম্বরের মধ্যেই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান, আশা সালাহউদ্দিনের      সংসদ নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে: প্রেস সচিব      নতুন সবজি বাজারে আসায় দাম কিছুটা কমেছে      

ভূ-রাজনীতির ঘূর্ণিতে বাংলাদেশ: পরাশক্তির ছায়া ও সার্বভৌমত্বের সংকট

Published : Friday, 24 October, 2025 at 7:12 PM  Count : 62

বাংলাদেশ যেন বিশাল মহাসমুদ্রের অন্তরালে ভেসে থাকা এক ছোট্ট নৌকা, যার ওপর মাঝে মাঝে পরাশক্তির ঢেউ এসে আঘাত হানে। কখনো মৃদু স্রোতের মতো শান্ত, কখনো বা ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতায় দুলে ওঠে চারদিক। একদিকে চীনের অর্থনৈতিক প্রলোভন আমাদের টানে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত আহ্বান ভেতর থেকে আমাদের দ্বিধায় ফেলে। ভারত, রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাববলয়ও ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে টানছে—প্রতিটি স্পর্শে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব যেন ক্রমেই এক সূক্ষ্ম সুতোয় ঝুলে থাকা বাস্তবতা।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করেও আমরা এখনও সেই অদৃশ্য ভারসাম্যের লড়াইয়ে লিপ্ত—যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা এবং জাতির আত্মপরিচয়ের পরীক্ষা। প্রশ্ন শুধু একটাই: এই বৈশ্বিক শক্তির ঘূর্ণির মধ্যে বাংলাদেশ কি নিজস্ব পথ খুঁজে পাবে, নাকি ইতিহাস আমাদের আবারও প্রভাবের পুতুলে পরিণত করবে?

বিশ্বরাজনীতির মানচিত্র আজ আর স্থিতিশীল নয়। প্রতিনিয়ত নতুন সমীকরণ, নতুন জোট, নতুন বিভাজন উদ্ভূত হচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থান কেবল ভূগোলিক নয়; এটি কৌশলগত গুরুত্বের এক কেন্দ্রবিন্দু। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা প্রভাববলয়, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া নেতৃত্বাধীন পূর্বমুখী শক্তিবলয়—এবং সেই দুই প্রভাবের মাঝখানে, সংকীর্ণ এক সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ।

এই ছোট্ট রাষ্ট্রটি কূটনৈতিক গুরুত্বে বিশাল। নীরব, কিন্তু গভীর প্রতিযোগিতার মাঝে প্রতিটি পদক্ষেপে রচিত হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ—আমাদের নিরাপত্তা, অর্থনীতি, এবং জাতীয় স্বনির্ভরতার পথ। প্রতিটি সিদ্ধান্তে লুকিয়ে আছে সম্ভাবনার আলো, সেই সঙ্গে ঝুঁকির অন্ধকারও। তাই আজ আমাদের দায়িত্ব শুধু বেঁচে থাকার নয়; আমাদের দায়িত্ব হলো সচেতনভাবে সেই পথ রচনা করা—যে পথ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতির মর্যাদা রক্ষা করবে।

বাংলাদেশের ভূগোলিক চিত্রই যেন তার নিয়তি। উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে ভারত ও পূর্বে মিয়ানমার—এই অবস্থান তাকে করে তুলেছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগবিন্দু। এই ভূ-অবস্থানই আজ বিশ্ব পরাশক্তিদের কাছে বাংলাদেশকে করে তুলেছে এক অপরিহার্য অংশীদার—কখনো সহযোগী, কখনো বা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। বঙ্গোপসাগরের নিচে থাকা গ্যাস, তেল, খনিজ এবং সম্ভাব্য জ্বালানি সম্পদ, সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা—সবকিছু মিলিয়ে এখন বাংলাদেশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক কূটনীতির বোর্ডে এক মূল্যবান চাল।

যে বাংলাদেশ এক সময় উন্নয়নের গল্প নিয়ে আলোচিত হতো, এখন সে দেশ ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের কেন্দ্রে। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট দেশটি এখন একাধারে চীনের অর্থনৈতিক বেল্টে যুক্ত, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, ভারতের ঐতিহাসিক বন্ধু এবং রাশিয়ার পুরনো অংশীদার। এই চার পরাশক্তির স্বার্থ এখন এখানে মিশেছে—অর্থনীতি, নিরাপত্তা, প্রযুক্তি, এমনকি নীতিনির্ধারণের স্তর পর্যন্ত।

যুক্তরাষ্ট্রের চোখে বাংলাদেশ এখন শুধু গণতন্ত্র বা মানবাধিকার আলোচনার দেশ নয়—এটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সামুদ্রিক নিরাপত্তা বলয়ের একটি অপরিহার্য অংশ। ওয়াশিংটনের কৌশলগত নথিতে বাংলাদেশকে বলা হয়েছে “key maritime partner”—অর্থাৎ এক গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক সহযোগী। যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ যেন চীনের প্রভাববলয় থেকে দূরে থেকে পশ্চিমা জোটের সঙ্গে নিজেদের সামঞ্জস্য রাখে। এজন্যই তারা কূটনৈতিকভাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বাধীন নির্বাচন ইত্যাদি ইস্যুগুলো সামনে আনে, যা একদিকে রাজনৈতিক নৈতিকতা হিসেবে উচ্চারিত হলেও, অন্যদিকে তা কৌশলগত চাপের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

অন্যদিকে চীন বাংলাদেশকে দেখে তাদের “Maritime Silk Road”-এর অন্যতম গেটওয়ে হিসেবে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর আওতায় চীনের বিনিয়োগ এখন বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে অপরিহার্য ভূমিকা রাখছে। পদ্মা সেতু রেলসংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ি বন্দর, পায়রা প্রকল্প—এসবের প্রতিটিতেই চীনের অর্থ, প্রযুক্তি এবং উপস্থিতি স্পষ্ট। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা একে দেখে চীনের ‘debt-trap diplomacy’ হিসেবে—যেখানে আর্থিক সহযোগিতার আড়ালে রাজনৈতিক প্রভাবের সুতো টানা হয়। ফলত বাংলাদেশ এখন এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে—যেখানে উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়াস প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে লিপ্ত।

ভারত, বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ও ঐতিহাসিক মিত্র, এই সমীকরণের আরেকটি অদৃশ্য চালক। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে পানি, বিদ্যুৎ, বাণিজ্য ও সীমান্ত নিরাপত্তা—প্রায় সবক্ষেত্রেই ভারতের প্রভাব গভীর। কিন্তু ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে ভারতের ভূরাজনীতি অনেক জটিল। তারা একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে QUAD জোটে যুক্ত; অপরদিকে রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক নিবিড়। ফলে বাংলাদেশকে ঘিরে ভারতের অবস্থান দ্বিমুখী—তারা যেমন চায় চীনের প্রভাব এখানে সীমিত থাকুক, তেমনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও নিজেদের প্রভাব অটুট রাখতে চায়।

রাশিয়া, যাকে এক সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে দেখা হতো, আজও তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে ভিন্ন এক মাত্রায়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে রাশিয়ার ভূমিকা বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় এক বড় পদক্ষেপ। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার প্রভাব কিছুটা সীমিত হয়েছে। তবুও মস্কো এখনো ঢাকাকে দেখে দক্ষিণ এশিয়ায় এক নিরপেক্ষ মিত্র হিসেবে—যেখানে সামরিক প্রযুক্তি, জ্বালানি সহযোগিতা এবং কৌশলগত সমর্থন এখনো পারস্পরিক আস্থার প্রতীক।

এই চার পরাশক্তির আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। এই সমুদ্র এখন আর কেবল বাণিজ্যের পথ নয়, বরং এক বিস্তৃত ভূ-রাজনৈতিক সংঘর্ষের মঞ্চ। মার্কিন ও ভারতীয় নৌবাহিনী এখানে যৌথ টহল বাড়াচ্ছে; চীন তাদের নৌঘাঁটি ও বন্দর চেইন সম্প্রসারণ করছে; রাশিয়া চায় এখান থেকে জ্বালানি রপ্তানির সুযোগ। আর এই প্রতিযোগিতার মাঝখানে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হচ্ছে তার সামুদ্রিক সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক স্বার্থ, এবং আঞ্চলিক শান্তির ভারসাম্য।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ঐতিহাসিকভাবে নিরপেক্ষতার নীতিতে প্রতিষ্ঠিত—“সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।” এই দর্শন দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কূটনৈতিক ভারসাম্যের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু আজকের বাস্তবতা অনেক কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রচাপ, চীনের বিনিয়োগের প্রলোভন, ভারতের প্রভাবের রাজনীতি এবং রাশিয়ার কৌশলগত আগ্রহ—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দোলনা এখন সূক্ষ্ম রশির ওপর ঝুলে আছে।

বিশ্বজুড়ে ছোট রাষ্ট্রগুলোর জন্য আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—কোন শক্তিবলয়ের দিকে ঝুঁকলে টিকে থাকা যাবে? শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের গল্প এখন সতর্কবার্তা হয়ে রয়েছে—যেখানে চীনের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দেশটি বন্দরের মালিকানা হারিয়েছিল। নেপালও দেখেছে, কীভাবে দুটি পরাশক্তির টানাপোড়েনে দেশটি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্থিতিশীলতা হারিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এসব উদাহরণ কেবল ইতিহাস নয়, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশও বটে।

এখানেই আসে সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। আজ সার্বভৌমত্ব শুধু সীমান্তরক্ষা নয়; এটি অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও তথ্যনির্ভর বাস্তবতা। বিদেশি সাহায্য, ঋণ, এমনকি উন্নয়ন প্রকল্পের নামেও এক নতুন প্রভাববলয় গড়ে উঠছে। কখনো তা আসে মানবাধিকারের ছদ্মবেশে, কখনো গণমাধ্যম বা এনজিওর তহবিলের মাধ্যমে, আবার কখনো প্রযুক্তির ভিতর দিয়ে—ডিজিটাল নজরদারির আকারে। বাংলাদেশের জন্য এখন তাই কেবল আর্থিক স্বাধীনতাই নয়, বরং ডিজিটাল সার্বভৌমত্বও এক বড় চ্যালেঞ্জ।

বিশ্বব্যবস্থার এই নতুন পরিসরে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমান পদক্ষেপ হতে পারে একাধিক বলয়ের সঙ্গে সমান দূরত্বে সম্পর্ক বজায় রাখা। ব্লক পলিটিক্স নয়, বরং ইস্যুভিত্তিক কূটনীতি। বাংলাদেশের উচিত এখন বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর (যেমন জাতিসংঘ, ওআইসি, আসিয়ান, সার্ক, বিমস্টেক) সঙ্গে সমন্বয় বাড়ানো, যাতে কোনো একক শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা না তৈরি হয়।

কূটনৈতিকভাবে আমাদের আরও দরকার একটি সুস্পষ্ট দীর্ঘমেয়াদি নীতি—যেখানে জাতীয় স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, অন্য কারও চাপ নয়। বাণিজ্যে বৈচিত্র্য, প্রতিরক্ষায় স্বনির্ভরতা, প্রযুক্তিতে নিজস্ব সক্ষমতা, এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তায় আঞ্চলিক সহযোগিতা—এই চার স্তম্ভে দাঁড়ালেই বাংলাদেশ টেকসইভাবে তার অবস্থান বজায় রাখতে পারবে।

আজকের পৃথিবীতে প্রভাবের যুদ্ধ বন্দুকের নয়, বরং তথ্য, প্রযুক্তি ও বর্ণনার যুদ্ধ। কে কাকে কিভাবে উপস্থাপন করছে—তাতেই নির্ধারিত হচ্ছে কে শক্তিশালী, কে নির্ভরশীল। বাংলাদেশের এখন প্রয়োজন নিজের কণ্ঠে নিজের গল্প বলা; নিজের অবস্থান থেকে বিশ্বকে বোঝানো যে, আমরা শুধু ভূগোলের নয়, আদর্শেরও রাষ্ট্র।

ইতিহাস সাক্ষী—যে দেশ নিজের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে বুঝতে ব্যর্থ হয়, সে কেবল অর্থনৈতিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের তাই এখন দরকার এক নতুন কূটনৈতিক আত্মবিশ্বাস—যেখানে উন্নয়ন হবে স্বাধীনতার সঙ্গে, আর বন্ধুত্ব হবে সার্বভৌমত্বের শর্তে।

মো: মাজেম আলী মলিন, সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

আরএন


LATEST NEWS
MOST READ
Also read
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000.
Phone: PABX- 41053001-06; Online: 41053014; Advertisement: 41053012.
E-mail: [email protected], news©dailyobserverbd.com, advertisement©dailyobserverbd.com, For Online Edition: mailobserverbd©gmail.com
🔝
close