সব স্বাস্থ্যসূচকের মধ্যে বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বড় ব্যবধানটি দেখা যাচ্ছে সিজারিয়ান সেকশন অপারেশনের হারের মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ, সুদানের কিছু এলাকায় এই হার মাত্র ০.০৫ শতাংশ—অর্থাৎ প্রতি দুইশ গর্ভবতী মায়ের মধ্যে মাত্র একজনের সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়। এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যায় তুরস্কে, যেখানে এই হার ৫৮ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন মায়ের মধ্যে ৫৮ জনের সিজার করা হয়। বাংলাদেশের প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে এই হার ৯০ শতাংশের উপরে, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত।
সন্দেহ নেই, সিজারিয়ান সেকশন অপারেশনের হার বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। ২০১৫ সালে ১৬৯টি দেশের এক সামষ্টিক উপাত্তে দেখা যায়, তখন বিশ্বব্যাপী সিজারিয়ান হার ছিল ২১ শতাংশ। যেখানে ২০০০ সালে এই হার ছিল মাত্র ১২ শতাংশ। অর্থাৎ এই সময়ে সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে সন্তান জন্মদানের হার যেমন বাড়ছে, তেমনি সিজারিয়ান সেকশন অপারেশনের হারও সমান্তরালে বাড়ছে। এই দুটি হারের একযোগে বৃদ্ধি সিজারিয়ান অপারেশনের সংখ্যাকে আকাশচুম্বী করে তুলেছে।
বাংলাদেশে সিজারিয়ান সেকশন অপারেশনের হার কত?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা যায়, ২০২২ সালে দেশে সিজারিয়ান অপারেশনের হার ছিল ৪১.৪ শতাংশ। অর্থাৎ মোট জন্মগ্রহণ করা শিশুদের মধ্যে ৪১.৪ শতাংশ শিশু সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে জন্ম নেয়।
গত কয়েক বছরে দেশে সিজারিয়ানের হার প্রতি বছর গড়ে ৯ শতাংশ হারে বেড়েছে বলে জানিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন—৪১.৪ শতাংশ সিজারিয়ান হার মানে হলো, দেশে মোট (বাড়িতে ও হাসপাতালে উভয়ে) জন্মগ্রহণ করা শিশুদের মধ্যে এই হার প্রযোজ্য।
ধরা যাক, বাংলাদেশে ২০২২ সালে ৩০ লক্ষ শিশুর জন্ম হয়েছে। তাহলে এর মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষ ৪২ হাজার শিশু সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে সন্তান প্রসবের হার ৫০ শতাংশ। বাকি ৫০ শতাংশ প্রসব হয় বাড়িতে। সেই হিসেবে এই ১২ লক্ষ ৪২ হাজার সিজার হয়েছে ১৫ লক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের বিপরীতে। এর মানে, বর্তমানে বাংলাদেশে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সিজারিয়ান সেকশন অপারেশনের হার ৮০ শতাংশেরও বেশি।
২০১৫-১৬ সালে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, দেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি হাসপাতালে সিজার হার ছিল ৭০ শতাংশ, আর প্রাইভেট ক্লিনিকে প্রায় ৯০ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক সিজারের এই হার সম্ভবত বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ।
মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য ঝুঁকি
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ নারী শিক্ষা, নারীর কর্মসংস্থান, নারীর আর্থসামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু সেই অগ্রগতিকে ম্লান করে দিয়েছে মাতৃমৃত্যু হার কমাতে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা এবং নবজাতক ও এক বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু হারের স্থবিরতা।
সিজারিয়ান সেকশন, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশগুলোতে, স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যেসব গর্ভবতী স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্মদানে সক্ষম—তাদের সিজার করানো হলে তা মা ও শিশুর মৃত্যুসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের মা ও শিশু মৃত্যুর বর্তমান চিত্র সম্ভবত উচ্চ সিজারিয়ান সেকশন হারের একটি অবধারিত ফলাফল।
বর্তমানে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে স্বাভাবিক প্রসব প্রায় হয় না বললেই চলে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা স্বাভাবিক প্রসব করানোর দক্ষতা অর্জনের সুযোগ হারাচ্ছেন। এর ফলে তারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে স্বাভাবিক প্রসব করাতে অসমর্থ হয়ে পড়ছেন। এই ধারা চলতে থাকলে, ভবিষ্যতে দেশে স্বাভাবিক প্রসব করানোর মতো দক্ষ ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী পাওয়া যাবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ২০ শতাংশের বেশি সিজারিয়ান হার মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু এবং তাদের পরবর্তী জীবনের স্বাস্থ্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের ক্লিনিকগুলোতে ৯০ শতাংশ সিজারের হার নারী ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য এক বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিজারিয়ান সেকশনের এই মহামারী এখনই প্রতিহত করা প্রয়োজন।
অধ্যাপক ডাঃ শেখ নাজমুল হুদা
MBBS, M.Phil, PhD
চেয়ারম্যান, জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিভাগ
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি
ডাঃ শেরশাহ সৈয়দ
FRCOG, MBBS
প্রাক্তন সভাপতি, অবস্টেট্রিকাল ও গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব পাকিস্তান
আরএন