বাংলাদেশসহ নয়টি দেশের ওপর পর্যটন ও কর্ম ভিসার উপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই নির্দেশনা কার্যকর হবে ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ ২০২৬ এর জানুয়ারি থেকে আর সংযুক্ত আরব আমিরাতে যেতে পারবে না।
এখন প্রশ্ন হলো তাতে বাংলাদেশের উপর কী প্রভাব পড়তে পারে। সবচেয়ে ভীতিকর প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে পড়তে যাচ্ছে তা প্রায় নিশ্চিত। অনেকেই মনে করেন আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হলো পোশাক খাত। কিন্তু কথাটি ঠিক নয়। আমাদের অর্থনীতিকে মূল যে শক্তিটি বাঁচিয়ে রেখেছে তাহলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানো দেশের তালিকায় প্রধান তিনটির একটি।
সৌদি আরবের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক থাকে এই দেশে। সংখ্যাটা কিন্তু নেহাত কম হয়। প্রায় ১২ লক্ষ শ্রমিক সংযুক্ত আরব আমিরাতে কাজ করে। যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ। ভারত, পাকিস্তানের পরেই সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রবাসী সেখানে থাকে। সবসময়ই রেমিটেন্স আসার লিস্টে সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সেরা তিনে থাকে এই দেশ।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় আসে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে দেশটি থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা ৩.১২ বিলিয়ন ডলার আসে। যা মোট বৈদেশিক আয়ের প্রায় ১৬ ভাগ। আমাদের অর্থনীতিতে কতটা অবিশ্বাস্য ভূমিকা রাখে এই দেশের প্রবাসীরা। কিন্তু ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেশের অর্থনীতিকে একটা বড় ধরনের সংকটে ফেলতে পারে। যা আমার মূল আলোচনার বিষয়।
বেকারত্বের করাল গ্রাসে পতিত আমাদের দেশের কিছু যুবক এতদিন সেখানে কাজ করার সুযোগ পেত, তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে। যেসব বাংলাদেশি এতদিন সেখানে কাজ করতেন, তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হলেই হয় দেশে ফিরতে হবে, না হলে অবৈধ উপায়ে পালিয়ে কাজ করতে হবে। পালানো অবস্থায় একবার ধরা পড়লেই জেল, জরিমানা! যারা দেশে ফিরবে কিন্তু কাজে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। কতটা ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হতে পারে চিন্তা করা যায়?
সবচেয়ে বড় বিপদজনক খবর হচ্ছে, বাংলাদেশ ছাড়াও অন্যান্য যে দেশগুলোর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেগুলো হলো- উগান্ডা, ক্যামেরুন, লেবানন, সোমালিয়া, সুদান, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং লিবিয়া। মানে উগান্ডা, সুদান, সোমালিয়ার কাতারে চিন্তা করা হচ্ছে বাংলাদেশের নাম! লিস্টের বেশির ভাগ দেশই হয় যুদ্ধ চলতেছে অথবা যুদ্ধ বিধ্বস্ত অথবা ভীষণ রকম বাজে অবস্থা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ভরা এমন পরিস্থিতি। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশ কেনো? বাংলাদেশকে তারা কোনটা ভাবতেছে! যা নিশ্চিত ভাবেই আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের ভাবমূর্তির প্রশ্ন। বিনিয়োগকারী যদি বাংলাদেশকে এসব দেশের কাতারে দেখে তাহলে নিশ্চিত ভাবেই এখানে বিনিয়োগ করার ইচ্ছা বা আগ্রহ দুটোই হারিয়ে ফেলবে।কার্যত দেশের প্রত্যেক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ হ্রাস পাবে যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের উপর।
বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশই আসে দেশটি থেকে। যদি এই প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় কিংবা বন্ধ হয় তাহলে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর পড়বে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুরোপুরি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের উপর নির্ভরশীল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেলে জরুরি পণ্য (যেমন: জ্বালানি তেল, খাদ্য) আমদানিতে সমস্যা হবে, দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা কঠিন হবে, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটবে, সেই সাথে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা কমে যাবে, যা বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করবে।
বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে গেলে দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটবে, যার ফলে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে এবং সামগ্রিক ভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, যা জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেবে ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি করবে। এই পরিস্থিতি অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করবে এবং রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীরা চাপের মুখে পড়বেন।
সর্বোপরি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা নিষেধাজ্ঞা বাংলদেশের অর্থনীতির জন্য নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। যা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। এ জন্য ইস্যুটিকে সরকারের সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আমিরাত সরকারের সাথে যোগাযোগ বাড়ানো এবং পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনে যথাযথ ভাবে কাজ করতে হবে। অন্যথায় অর্থনীতি যে চোরাবালিতে দেশ পড়তে যাচ্ছে, অসময়ে যতই হাত-পা ছুড়তে থাকি, ডাঙ্গায় ওঠা সম্ভব হবে না।
এমএ