বাংলাদেশের জন্মকথা রক্তে লেখা এক অনন্ত কাব্য। ১৯৭১ সালের সেই দিনগুলোতে কিশোরের হাতে বন্দুক কাঁপত, মায়ের কোলে লাশ হয়ে ফিরত ছেলে, অর্ধনগ্ন বোনেরা ধর্ষণের শিকার হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেত, আর আকাশ কাঁপিয়ে উঠত “জয় বাংলা” ধ্বনিতে। মুক্তিযোদ্ধারা তখনো খাবার পেতেন না দিনের পর দিন, তবুও ক্ষুধার্ত শরীরে লড়েছেন, কাদা-রক্ত মাখা মাঠে শুয়ে থেকেও শত্রুর দিকে তাক করেছেন বুকে শেষ বুলেট। তাদের চোখে ছিল কেবল এক স্বপ্ন- স্বাধীনতার স্বপ্ন, লাল-সবুজ পতাকার স্বপ্ন। তারা ছিলেন অন্ধকার ভেদ করা আলোর যোদ্ধা, যারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ।
কিন্তু কী অসহ্য বেদনা- আজ সেই মুক্তিযোদ্ধারাই আমাদের চোখের সামনে অপমানিত হচ্ছেন। যাদের পদতলে মাথা নত করে দাঁড়ানো উচিত ছিল জাতির প্রতিটি নাগরিকের, তাদেরকেই টেনে-হিঁচড়ে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, তাদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, তাদের রক্তাক্ত শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। দৃশ্যগুলো দেখে মনে হয়, যেন ১৯৭১-এর রণাঙ্গনে বীরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে আমরা আজ নিজেরাই অপমানের শেকলে বেঁধে দিচ্ছি। কেউ যদি কোনো অন্যায় করে থাকে দেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার হতে পারে। কিন্তু মবের সৃষ্টি করে আইন হাতে তুলে নেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
এসব দৃশ্য কেবল বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়; এগুলো আমাদের জাতীয় বিবেকের মৃত্যু, আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধের কফিনে শেষ পেরেক, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নগ্নতম পতন। একদিন যারা প্রাণ দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, আজ আমরা কি এতটাই পাষাণ হয়ে গেছি যে তাদের চোখের পানি আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় না? মুক্তিযোদ্ধার আর্তনাদ আমাদের কানে বাজে না?
তাহলে কি সত্যিই আমরা ভুলে গেছি কারা আমাদের পতাকাকে লাল-সবুজ রঙে রাঙিয়ে তুলেছিল? আমরা কি ভুলে গেছি কারা নিজেদের জীবনকে বিসর্জন দিয়ে আমাদের সন্তানদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এনে দিয়েছিল? না কি আমরা ইচ্ছাকৃত ভাবেই নিজের ইতিহাসকে মাটিচাপা দিতে চাই? তাই সকলের দলমতের ঊর্ধ্বে এসে এই একটি জায়গা ঠিক রেখে সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করা। অন্যথায় এ লজ্জ্বায় শুধু কিছু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, হবে পুরো জাতি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত নয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালি জাতি সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। এর পরিণতি ঘটে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এই যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ গেছে, দুই লাখের বেশি নারী সম্মান হারিয়েছেন, আর এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই ত্যাগ-তীতিক্ষার কাহিনী আমাদের জাতীয় ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু।
মুক্তিযোদ্ধারা তাই কেবল যোদ্ধা নন, তারা এই রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জীবন্ত প্রতীক। তাদের লাঞ্ছনা মানে পুরো ইতিহাসকে অস্বীকার করা, স্বাধীনতার ভিত্তিকে অমান্য করা। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে আজকের প্রজন্মের অনেকেই এই ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইতিহাস শিক্ষার অভাব, রাজনৈতিক বিভাজন এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক বর্ণনা না পাওয়া- সবকিছু মিলিয়ে ইতিহাসের প্রতি অজ্ঞতা বিস্তার লাভ করছে। এর ফলে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করছে, তারা বোঝেই না আসলে কাকে আঘাত করছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির একটি বড় সমস্যা হলো- এখানে মতাদর্শ ও নীতির জায়গায় অনেক সময় গুণ্ডামি, সন্ত্রাস ও প্রতিহিংসা প্রাধান্য পায়। দলীয় স্বার্থে ভাড়াটে বাহিনী ব্যবহার করা আমাদের রাজনীতির এক দুঃখজনক বাস্তবতা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে প্রকাশ্যে মানুষকে মারধর করা, আতঙ্ক সৃষ্টি করা, এমনকি বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে।
রাজনীতি মূলত রাষ্ট্র পরিচালনার শিল্প, জনগণের কল্যাণের হাতিয়ার। কিন্তু যখন এটি নীতিহীন হয়ে পড়ে, তখন সেখানে প্রবেশ করে অমানবিকতা। মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালানো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আসলে রাজনীতি বোঝে না; তারা বোঝে ক্ষমতার প্রদর্শন, ভয় সৃষ্টি ও দমননীতি। এর মাধ্যমে তারা শুধু ব্যক্তিকে নয়, গোটা সমাজকেই বার্তা দেয় যে ন্যায়-নীতি এখানে অচল।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের মৌলিক দায়িত্ব। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব আরও বাড়তি, কারণ তারা রাষ্ট্রের জন্মদাতা। কিন্তু যখন তাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে, তখন এটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতারই প্রতিফলন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের দায়িত্ব হলো অপরাধী যেই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক সময় দেখা যায়, রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে অপরাধীরা রক্ষা পায়। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়- তারা মনে করে, ক্ষমতাবানদের জন্য আইন নেই। এই আস্থাহীনতা সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি হামলার ঘটনা তাই শুধু ব্যক্তিগত আঘাত নয়, এটি আইনের শাসনের দুর্বলতার প্রতীকও।
যে সমাজ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিতে জানে না, সে সমাজ ধীরে ধীরে নৈতিক দেউলিয়াত্বে পতিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের নৈতিক মানদণ্ড। তাদের ত্যাগের শিক্ষা নতুন প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস। কিন্তু যখন সমাজ চুপ করে থাকে, কিংবা কেউ কেউ এই ঘটনাকে তুচ্ছ মনে করে, তখন প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
একটি প্রজন্ম যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলে যায় বা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে, তখন তারা মানবিক মূল্যবোধ থেকেও দূরে সরে যায়। বর্বরতা, সহিংসতা, অমানবিকতা তখন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আজকের মুক্তিযোদ্ধাদের লাঞ্ছনা সেই নৈতিক অবক্ষয়েরই প্রতিফলন।
বিশ্ব ইতিহাসে দেখা যায়, যে জাতি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে, তারা তাদের বীরদের সর্বোচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে জাতীয় নায়ক হিসেবে আজও সম্মান করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতার যোদ্ধারা এখনো সমাদৃত। ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদের নামে এখনো শহর-রাস্তা সাজানো হয়।
কিন্তু বাংলাদেশে আমরা উল্টো চিত্র দেখছি- যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা অপমানের শিকার হচ্ছেন। এটি কেবল দেশের ভেতরেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আমাদের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন, তারা এই পরিস্থিতি দেখে বিস্মিত হচ্ছেন। ফলে এ ঘটনা আমাদের আন্তর্জাতিক মর্যাদার সঙ্গেও সম্পর্কিত।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত
সমাজবিজ্ঞানী ড. আনোয়ার হোসেন মন্তব্য করেছেন, “যে সমাজ তার ইতিহাসকে অবহেলা করে, সে সমাজ ক্রমশ অনৈতিকতায় নিমজ্জিত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের লাঞ্ছনা সেই অনৈতিকতারই প্রকাশ।”
আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে সমাজে এ ধরনের বর্বরতা ঠেকানো সম্ভব নয়। অপরাধীরা যদি বার বার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে রেহাই পায়, তবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আঘাতও অব্যাহত থাকবে।”
একইসঙ্গে ইতিহাসবিদ সেলিনা হোসেন মনে করিয়ে দেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অপমান মানে আসলে পুরো জাতির ইতিহাসকে অস্বীকার করা। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা নিশ্চিত করতেই হবে।”
মুক্তিযোদ্ধাদের লাঞ্ছিত করা শুধু একটি অপরাধ নয়, এটি একটি ভয়ঙ্কর নৈতিক সংকেত। এটি প্রমাণ করে, আমরা আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান রক্ষা করা মানে আমাদের আত্মপরিচয় রক্ষা করা। যদি আমরা তা না করি, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এই লজ্জার ভার বহন করবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। তাদের লাঞ্ছনা মানে স্বাধীনতার মর্যাদা হরণ করা। এই অপমান আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও ভবিষ্যতের প্রতি আঘাত। এখন সময় এসেছে আমরা নিরপেক্ষ ভাবে ভাবি, ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ হই, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা রক্ষা করি।
আজ যদি মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ না থাকেন, তবে কোনো নাগরিকই নিরাপদ নয়। আজ যদি মুক্তিযোদ্ধারা অপমানিত হন, তবে অপমানিত হয় পুরো জাতি। তাই লজ্জিত বাংলাদেশকে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদের একটাই করণীয়- বর্বরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান রক্ষা করা, এবং ইতিহাসকে জীবন্ত রাখা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক (বিভাগীয় প্রধান সমাজবিজ্ঞান বিভাগ) সাংবাদিক ও কলামিস্ট ডেইলি অবজারভার।