পটুয়াখালীর দশমিনায় ভালো নেই নৌকা কারিগররা। গ্রামীণ এলাকায় অসংখ্য রাস্তাঘাট নির্মাণ ও পাঁকাকরণের ফলে সড়ক যোগাযোগের ব্যাপক সম্প্রসারণ, ছোট ও মাঝারি আকারের নদী-খালে সেতু হওয়া, খেয়াঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়া, খাল শুকিয়ে যাওয়া, স্বল্প দূরত্বের নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে ইঞ্জিনচালিত স্টিলের জলযানের ব্যবহারসহ নানা কারণে নৌকার চাহিদা কমে গেছে। ফলে প্রতি বছরই কর্মহীন হয়ে পড়ছেন অনেক কারিগর।
তবে এখনো জেলেদের মাছ ধরার নৌকা তৈরি করেই কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করছে তারা। মাঝেমধ্যে জেলে-নৌকার চাহিদা বাড়লেও প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় আগের তুলনায় লাভ কমে গেছে কয়েকগুণ। তাই জেলেদের ওপর ভর করেই উপজেলায় নিভু-নিভু করে টিকে আছে এ শিল্প। সরকারি সহযোগিতা না পেলে নৌকা শিল্পটি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, তেঁতুলিয়া ও বুড়াগৌরঙ্গ নদীসহ অসংখ্য নদী-খাল বেষ্টিত উপজেলাটির বিভিন্ন এলাকায় একসময় শতাধিক কারিগর নৌকা তৈরি করলেও বর্তমানে সে সংখ্যা নেমে এসেছে তলানিতে।
কারিগরদের ভাষ্য, একদিকে যেমন বেড়েছে শ্রম, লোহা ও কাঠের দাম—অন্যদিকে নানান কারণে কমেছে নৌকার চাহিদা। বাধ্য হয়েই পেশা বদলে নিচ্ছেন অনেকেই।
একসময় উপজেলায় রাস্তাঘাটের অভাবে মানুষের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল কেড়ার নৌকা। প্রতি গ্রামেই ছিল প্রায় অর্ধশত নৌকা। কিন্তু কালের প্রবাহে পাঁকা রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ এবং নৌপথে ট্রলার, লঞ্চ, স্পিডবোট বৃদ্ধির কারণে বিলুপ্ত হয়েছে গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির এই ঐতিহ্যবাহী কেড়ার নৌকা। তাই আগের মতো হিড়িক তো দূরের কথা—বর্তমানে একটি নৌকার অর্ডারও পান না কারিগররা।
এছাড়া কৃষিপণ্য আনা-নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত বড় নৌকাগুলোর চাহিদাও এখন নেই। কারণ সড়কপথেই এসব পণ্য পরিবহন করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে নৌপথে পরিবহনের প্রয়োজন হলেও সেখানে স্টিলবডির ট্রলার বা ছোট কার্গো ব্যবহৃত হয়। ফলে এসব বড় নৌকা তৈরির কাজ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
অন্যদিকে ছোট-বড় নদীতে সেতু নির্মাণের কারণে অধিকাংশ খেয়াঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। এতে যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত খেয়া নৌকার চাহিদাও বিলুপ্ত হয়েছে।
তবে সারা বছরই চাহিদা থাকে জেলেদের মাছ ধরার নৌকার। আর এগুলো বানিয়েই কোনোরকমে টিকে আছে কয়েকজন কারিগর। জানা যায়, বর্তমানে উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২০টি নৌকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানে কাজ করেন প্রায় অর্ধশত কারিগর। আকারভেদে প্রতিটি নৌকার দাম ২৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকা।
উপজেলার রণগোপালদী ইউনিয়নের আউলিয়াপুর লঞ্চঘাট এলাকার কারিগর জালাল মোল্লা বলেন, “আমি অনেক বছর ধরে এ পেশায় আছি। আগের মতো নৌকার অর্ডার নেই। শুধু জেলেরা অর্ডার করে। মাঝে মাঝে অর্ডার ছাড়া নৌকা বানাই—জেলেরা দরকার অনুযায়ী কিনে নেয়। চৌদ্দ-পনের হাত লম্বা, আড়াই-তিন হাত চওড়া একটি নৌকা তিনজন মিস্ত্রি মিলে চার দিনে বানাতে পারে। সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। কাঠ, লোহা, আলকাতরা ও মজুরি দিয়ে তিন-চার হাজার টাকার বেশি লাভ থাকে না। অনেক সময় মাসজুড়ে একটি নৌকাও বিক্রি হয় না—অর্ডারও পাই না। তখন ধার-দেনা করে চলতে হয়।”
পূর্ব আউলিয়াপুর গ্রামের আবু কালাম বলেন, “আমাদের পূর্বপুরুষরা এ পেশায় ছিলেন। বংশপরম্পরায় আমিও আছি। কিন্তু আগের মতো চাহিদা না থাকায় ব্যবসা অনেক কমে গেছে। অনেকেই পেশা বদলে ফেলেছে।”
বাঁশবাড়িয়া লঞ্চঘাট এলাকার কারিগর লাল মিয়া বলেন, “এনজিও থেকে ঋণ এনে নৌকা বানাই। আগের তুলনায় বিক্রি কমে গেছে। সবকিছুর দাম বাড়ায় এখন সীমিত লাভ হয়। প্রতি শ্রমিককে দুই বেলা খাওয়ানোসহ ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকা মজুরি দিতে হয়। লাভের টাকায় ঋণের কিস্তি দিয়ে যা থাকে, তাতেই কোনোভাবে সংসার চলে।”
দশমিনা সদর ইউনিয়নের কাউনিয়া কেদিরহাট এলাকার কারিগর রেজাউল জানান, “আগে বছরে ৫০–৬০টি জেলে নৌকা বিক্রি করতে পারলেও এখন ২০–২৫টির বেশি বিক্রি হয় না। তাই এখন এ পেশার পাশাপাশি অন্য কিছু করারও চেষ্টা করছি।”
কারিগররা আশা করছেন—সরকারি উদ্যোগ ও সহযোগিতা পেলেই দশমিনার নৌকা শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
এদিকে, ঐতিহ্যবাহী এই ক্ষুদ্র শিল্পটি বাঁচিয়ে রাখতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।
বিসিক পটুয়াখালীর সহকারী মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আলমগীর সিকদার মুঠোফোনে বলেন, “উপজেলা পর্যায়ে আমাদের অফিস না থাকায় অনেক কিছু জানতাম না। দশমিনায় এমন শিল্প আছে—আপনার মাধ্যমে জানলাম। খুব শিগগিরই আমরা দশমিনায় গিয়ে কারিগরদের নিবন্ধনের আওতায় আনব। তারা চাইলে আর্থিক ঋণ এবং অন্যান্য সহযোগিতা দেওয়া হবে। শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে আমরা যথাযথ উদ্যোগ নেব।”
এসটি/আরএন