নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতে ভিড় বাড়ছে। বাড়ছে বিচ্ছেদ ও সংসার ভাঙার ঘটনা। যার মূলে রয়েছে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব, বাল্য বিয়ে, পারিবারিক সহিংসতা, যৌতুক,আর্থিক সমস্যা এবং মতানৈক্য। এই সমস্যা গুলো শহর ও গ্রাম উভয় এলাকাতেই দেখা যাচ্ছে অনেক বেশি। তবে কারণ গুলোতে ভিন্নতা আছে। যেমন-শহরে নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া ও পরকীয়া এবং গ্রামে মাদক সেবন, বাল্য বিয়ে, যৌতুক দাবি ও জুয়ার আসক্তি। এভাবে বাবা-মার বিচ্ছেদে হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। এতে করে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাঘা উপজেলায় একটি বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক বর্তমানে কাজ করছে পারিবারিক সহিংসতা ,বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ ও দাম্পত্য কোলহ নিয়ে। তাদের জরিপে দেখা গেছে, গত এক বছরে শালিশী বৈঠকের মাধ্যমে প্রায় চার শতাধিক পারিবারিক কলহ তারা নিরসন করেছেন। একই সাথে সকল দেনা-পাওনা মিটিয়ে তিন শতাধিক ছেলে-মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়েছেন। এ সকল বিচ্ছেদের প্রধান কারণ বাল্যবিয়ে, পরকিয়া, মাদক সেবন, পারিবারিক কোলহ যৌতুক এবং দারিদ্রতা। এ ছাড়া প্রায় দুই শতাধিক শালিশ করেছেন উপজেলার দু’টি পৌর সভা ও ৭ টি ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত পারিবারিক আদালত।
ব্র্যাকের আইন সহায়তা ব্যবস্থাপক মোমিনুল ইসলাম জানান, বর্তমানে বিয়ের পর নতুন সংসারও টিকছে না। প্রতি বছর যে পরিমাণ বিয়ে হচ্ছে, তার অর্ধেক তালাকে রূপ নিচ্ছে। মূলত পরকীয়া, স্বামী মাদকাসক্ত, যৌতুক নিয়ে দ্বন্দ্ব, মতের অমিল, স্বামী-স্ত্রীর আয়ের টাকা নিয়ে বিরোধ এবং পারিবারিক অশান্তি-সহ নানা কারণে তালাক হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, নিম্নবিত্ত ও ধনীদের মধ্য বেড়েছে ঘর ভাঙার প্রবণতা। গ্রামাঞ্চলে তালাকের মূলে রয়েছে- স্বামীদের মাদক সেবন, যৌতুক দাবি আর জুয়ায় আসক্তি। এ দুই সমস্যার সঙ্গে শহরাঞ্চলে অহংবোধ (ইগো) আর পরকীয়ার কারণে হুটহাট ঘর ভাঙছে অনেকের। এভাবে বাবা-মার বিচ্ছেদে হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। এতে করে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
স্থানীয় লোকজন জনান, কেউ ভালোবেসে, কেউ পরিবারের সিদ্ধান্তে ঘর বাঁধেন। এরপর শুরু হয় একটি সুখী সংসার “পরশ পাথরের গল্প’’। ধন নয়, মান নয়, এইটুকু বাসা করেছিনু আশা। প্রথম দিকে দাম্পত্য জীবনে বোঝা পড়াটা হয়ে ওঠে সোনার হাতে সোনার কাকন, কে-কার অলংকারের মতো ধাধানো। কিন্তু বুকভরা আশা আর রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঘর বাঁধলেও সর্বক্ষেত্রে ধরা দিচ্ছে না সুখপাখি। কখনো কখনো মেহেদীর রঙ মোছার আগেই ভেঙে যাচ্ছে অনেকের সংসার। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সংসারের বন্ধন দুর্বল হচ্ছে ক্রমেই। যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে মানুষ। ভালো লাগা, ভালোবাসাও যাচ্ছে কমে। ফলে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ।
এক সমিক্ষা বলছে, গত এক দশকে বদলে গেছে তালাকের ধরণ। আগে ৭০ শতাংশ তালাকের ঘটনা ঘটতো স্বামী কর্তৃক। কিন্তু সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে এই সত্য ভেঙ্গে যাচ্ছে সময়ের ব্যবধানে। এখন তালাকের ঘটনায় নারীরা পুরুষের চেয়ে দশগুণ এগিয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে ৮০ শতাংশ তালাকের ঘটনা ঘটছে স্ত্রী কর্তৃক।
বাঘা উপজেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে অত্র উপজেলায় নতুন বিয়ে নিবন্ধন হয়েছে ৬ হাজার ১৫০ টি।
এ প্রসঙ্গে বাজুবাঘা ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজি মো: রিপন আলী জানান, জুয়া আর মাদকে আসক্ত হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় স্বামী। তখন সেই স্বামী আর স্ত্রীর পুরোপুরি ভরণপোষণ দিতে পারেন না। এ ছাড়াও বাল্য বিয়ে এবং যৌতুকের কারণেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাকের ঘটনা ঘটছে।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী নারী-শিশু আদালতের আইনজীবি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সমাজ সেবক ফিরোজ আহাম্মেদ রঞ্জু বলেন, হয়তো স্বামী বিয়ে করে নতুন বউ পাচ্ছে, মা হয়তো বিয়ে করে আবার নতুন স্বামী পাচ্ছে, কিন্তু সমস্যায় পড়ছে বাচ্চা। সে হয়তো মায়ের কাছে থাকছে, বাবাকে পাচ্ছে না, আবার বাবার কাছে থাকছে, কিন্তু মাকে পাচ্ছে না। এতে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তাঁর মতে তালাকের প্রবণতা বন্ধে স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরে প্রতি সহনশীল ও যত্নবান হবার পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় করার বিষয়ে সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
এসব বিষয়ে কয়েকজন শিক্ষক ও সমাজ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মাদকাসক্ত, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, পরকীয়া, শারীরিক অক্ষমতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টিকটক, স্মার্টফোনের অপব্যবহার, ভুল বোঝাবুঝি, সন্দেহ প্রবণতা, স্বামী প্রবাসী হলে স্ত্রীর শ্বশুর পক্ষের লোকজনের অসহযোগিতা, সন্তান না হওয়া বা ছেলে সন্তান না হওয়া, একাধিক বিয়ের প্রবণতা, দম্পতিদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহনশীলতার অভাব, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি কারণে সংসার ভাঙছে।
আরএইচএফ/এসআর