Thursday | 23 October 2025 | Reg No- 06
Epaper | English
   
English | Thursday | 23 October 2025 | Epaper
BREAKING: সাইফ ও সৌম্যর রেকর্ড জুটিতে ২৯৭ রানের লক্ষ‍্য দিল বাংলাদেশ      দেশকে এগিয়ে নিতে নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন: মির্জা ফখরুল      টস জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ      সহজেই জয় পেল অস্ট্রেলিয়া      ইসরায়েলের পার্লামেন্টে পশ্চিম তীর দখলের বিল পাস      জেনেভা ক্যাম্পে দু'গ্রুপের সংঘর্ষে যুবক নিহত      কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি জামায়াতের, জানালেন প্রধান উপদেষ্টাকে      

শিক্ষাঙ্গনে মাদকের থাবা: বিপর্যস্ত প্রজন্মকে বাঁচাতে করণীয়

Published : Wednesday, 13 August, 2025 at 5:34 PM  Count : 176

আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল পঠন-পাঠনের কেন্দ্র নয়, বরং এক জাতির ভাবমূর্তি, সম্ভাবনা এবং নাগরিক চেতনার মহানায়কে সঞ্চার করে একটি আদর্শ সমাজ নির্মাণের মঞ্চ। ঢাকার টিএসসি থেকে শুরু করে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, বরিশাল—দেশজুড়ে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শুধু শিক্ষার স্থান নয়, বরং চিন্তার স্বাধিকার, সংস্কৃতির মুক্ত ডাক এবং প্রতিবাদের গর্বা-কণ্ঠ। কিন্তু আজ, সেই সব প্রাঙ্গণে—যেখানে এক সময় বাঙালির মুক্তচিন্তার বাতিঘর জ্বলে উঠত—দেখা যাচ্ছে এক নীরব, নিষ্প্রভ, তথাকথিত “অভিজাত আগুন” ছড়িয়ে পড়ছে, যার নাম ‘মাদক। অত্যন্ত  ভয়ঙ্কর যা তিলে তিলে জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। মূলত, অতিপ্রশস্ত মানসিক চাপ, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক অক্ষমতা এবং মানসিক সেবার অপ্রতুলতায় এই আগুন এখন স্থানে স্থানে ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। এই কলামে আমি চেষ্টা করেছি ঘটনার স্বাভাবিকতা বজায় রেখে—বিষয়টিকে মানবিক, সামাজিক, শাসন ও নীতিগত দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাণবন্তভাবে স্পর্শ করতে, বিশ্লেষণ করতে এবং প্রতিকার নির্দেশ করতে।

যদি প্রশ্ন রাখা হয়, “কেন শিক্ষাঙ্গনের এমন পরিনতি?”, তাহলে উত্তর আসবে। বিশ্ববিদ্যালয় তো তরুণ প্রজন্মের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ‘অভিলাষের নগরী’। এখানে থাকে আবাসিকতা, রাত জাগা সংস্কৃতি, রাজনৈতিক–সাংস্কৃতিক সংগঠন, যা এক ধরনের ‘ঝুঁকিপূর্ণ সুযোগের পরিকাঠামো’ তৈরি করে। পরীক্ষা-চাপ, ক্যারিয়ারের প্রতিযোগিতা, পারিবারিক প্রত্যাশা বা অস্থিরতা—এসব মানসিক চাপের ভেতর দিয়ে তরুণরা যেতে চায় স্বস্তির খোঁজে। মাদক ‘তাৎক্ষণিক বিশ্রাম’ দেখায়, যদিও কার্যত তা বিপর্যয় ডেকে আনে। বিশ্বের বহু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে তরুণরা বিষণ্নতা ও উদ্বেগে আক্রান্ত—এটাই আমাদের প্রেক্ষাপটেও প্রযোজ্য। ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিসংখ্যান দেখায়, বিগত তিন-চার বছরের মধ্যে হাজারের বেশি শিক্ষার্থীই মানসিক সহায়তা নিয়েছে, কিন্তু তাদের সংখ্যয়তা ও কাঠামো এখনও কমপক্ষে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এসবই ভোক্তাদের ‘প্রতারণা’-এর মতো হয়ে যায়—সহজ অনুকূলতা গোপনে বিপর্যয়ের চাকরি হতে পারে।

বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (Department of Narcotics Control – DNC) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে আনুমানিক ৮৩ লাখ (৮.৩ মিলিয়ন) মানুষ কোনো না কোনোভাবে মাদকাসক্ত, যা জাতীয় জনসংখ্যার প্রায় ৪.৯ শতাংশ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। (তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো ২২ জুন ২০২৪)।

বিভিন্ন গবেষণা ও সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, বাংলাদেশে মাদকের প্রধান প্রবেশ পথ হলো অরক্ষিত স্থল ও নদী সীমান্ত। ভারত, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন ও মেথামফেটামিন সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ঢুকছে। 

শহরের ক্যাম্পাস জুড়ে ছাত্রাবাস, ফ্ল্যাট, গোপন নেটওয়ার্ক, টেলিগ্রাম বা অনলাইন ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্ম, অবৈধ আর্থিক লেনদেন, এমনকি জীবনযাপনের ফরম্যাট দ্বারা তৈরি ‘ছায়া বিতরণ চেইন’ এই প্রবাহকে সহায়তা করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান করলেও, রাজনৈতিক চাপ, প্রশাসনিক পরোক্ষতা এবং সামাজিক নেটওয়ার্ক প্রশাসনের কাজকে অসম্পূর্ণ করে তোলে। ২০১৮ সালে কঠোর শাস্তিমূলক আইন প্রণয়নের পরও, মাদক ব্যাবসায়ীরা শূন্য থেকে নিরীহের মতো কোনো কলেজ বা ছাত্র পরিবারের ছদ্মবেশে ঢুকে পড়ে; দ্রুত ‘ক্রেডিট-ট্রাপ’ তৈরি করে। এসব চক্র ‘ডেপেনডেন্স’-এ পরিণত, যা ভেঙে দেওয়া সহজ নয়।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাদকের উপস্থিতি এখন এক ধরনের সামাজিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। মানসিক চাপ, একাকিত্ব এবং সঠিক কাউন্সেলিং বা পরামর্শ পাওয়ার সুযোগ না থাকায় অনেক তরুণ বিকল্প খুঁজে নেয়—যা হতে পারে মাদক বা অন্য কোনো সাময়িক আনন্দদায়ক অভ্যাস। পরিবারের পক্ষ থেকেও অনেক সময় এ সমস্যাকে “সাময়িক ভুল”, “অল্প দিনের কষ্ট”, “এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়” বা “চুপ করে থাকাই ভালো” বলে পাশ কাটিয়ে দেওয়া হয়। ফলে সমস্যার শুরুতেই তা গুরুত্ব পায় না, সময়মতো সঠিক সেবা মেলে না, সামাজিক লজ্জা ও ভয়ের কারণে অনেকে কাউন্সেলিং নিতে চায় না, আর ব্যক্তিগত কাউন্সেলিং সেবা অনেকের পক্ষে খরচ সাপেক্ষ হওয়ায় পাওয়াও কঠিন হয়। এসব মিলিয়ে তরুণদের জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক বিক্রির চিত্র এখন অনেকটাই বদলে গেছে। বিক্রেতারা আর খোলাখুলি অপরিচিত কেউ নয়—তারা হয়তো সহপাঠী, সাংস্কৃতিক কর্মী বা অতিথি সেজে আসে। তাই লক্ষ্য করে চালানো অভিযান সহজে এই নেটওয়ার্ক ভাঙতে পারে না। মাঝখানে থাকে কিছু ‘মধ্যবর্তী’ লোক, গোপন অর্থনৈতিক লেনদেন, মোবাইল ব্যাংকিং, ডিজিটাল মুদ্রা ও পাসওয়ার্ডভিত্তিক লেনদেনের মাধ্যমে বিক্রি-বাট্টা হয়। ক্যাম্পাসের বেজমেন্ট, হোস্টেলের নির্জন কোনা, চত্বর কিংবা ফাঁকা করিডোর—সবই হয়ে ওঠে ‘সেলস পয়েন্ট’। প্রশাসন অনেক সময়ই প্রস্তুত থাকে না।

এই সমস্যার সমাধান হতে পারে তিন ধাপে—স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা—যেখানে প্রতিটি ধাপ একে অপরকে সহায়তা করবে।

স্বাস্থ্য ধাপে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তাহে একবার কাউন্সেলিং সেশন চালু করা দরকার, ২৪ ঘণ্টা চালু থাকবে একটি হেল্পলাইন, আর থাকবে ‘গুড সামারিটান নীতি’। অর্থাৎ কেউ মাদকাসক্তকে সাহায্য করলে তাকে শাস্তি নয়, বরং প্রশংসা করা হবে। আন্তর্জাতিকভাবে এটি মৃত্যুহার কমাতে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের দ্রুত চিহ্নিত করে সহায়তা দিতে হবে, আর যারা পুনর্বাসন শেষে ফিরবে, তাদের জন্য গঠন করতে হবে সহায়ক গ্রুপ যাতে তারা সহজে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।

শিক্ষা ধাপে নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক ‘মাদক সচেতনতা’ ও ‘জীবন দক্ষতা’ শিক্ষা রাখা যেতে পারে। এতে তারা শিখবে কীভাবে মানসিক চাপ সামলাতে হয়, একাকিত্ব কাটাতে হয়, বা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হয়। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিজস্ব উদ্যোগে ‘অ্যান্টি-ড্রাগ সোসাইটি’ গড়ে তোলা যেতে পারে।

আইনশৃঙ্খলা ধাপে ক্যাম্পাস, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স দরকার। তারা একসাথে কাজ করে ক্যাম্পাসে মাদকের ‘ডার্ক স্পট’ চিহ্নিত করবে, নিয়মিত টহল দেবে, গোপন তথ্য সংগ্রহ করবে এবং প্রয়োজনে অভিযান চালাবে। দ্রুত ল্যাব টেস্ট ও ‘ড্রাগ-চেকিং’ ব্যবস্থা চালু করলে শিক্ষার্থীরা জানবে তারা আসলে কী খাচ্ছে—এতে সচেতনতা বাড়বে।

অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক সচেতনতামূলক ক্লাস, এলোমেলো ড্রাগ টেস্ট, গুড সামারিটান নীতি ও পিয়ার সাপোর্ট কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের দেশে ড্রাগ-চেকিং সহজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, আর এলোমেলো টেস্ট পাইলট প্রজেক্ট আকারে শুরু করা যেতে পারে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়তি আলো, সিসিটিভি ও অনলাইন রিপোর্টিং সিস্টেম চালু করে ‘পরিস্থিতি-ভিত্তিক প্রতিরোধ’ কার্যকর করা সম্ভব।

প্রথমেই দরকার ‘রিস্ক ম্যাপিং’—অর্থাৎ কোন সময়, কোন জায়গায়, কোন অনুষ্ঠানের সময় মাদক প্রবেশের ঝুঁকি বেশি তা চিহ্নিত করা। যেমন—সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ২টা, পার্কিং এরিয়া, নির্জন করিডোর, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা হোস্টেলের গভীর রাত—এসব জায়গা ও সময় নজরদারিতে রাখতে হবে।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে দশ দফা কর্মপরিকল্পনা নিতে পারে—যেমন টাস্কফোর্স, হেল্পলাইন, গুড সামারিটান নীতি, নবীন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, পিয়ার গ্রুপ, আলো ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি, ড্রাগ-চেকিং ডেস্ক, ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন নজরদারি, এলোমেলো টেস্ট পাইলট, অভিভাবক–শিক্ষক যোগাযোগ—সব মিলিয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ হবে। ৯০ দিনের রোডম্যাপের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এগোনো সম্ভব।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নীতি নির্ধারণে গবেষণার তথ্য ব্যবহার করা—গোপন জরিপ, ঘটনা রিপোর্ট, কাউন্সেলিং ডেটা, পুনর্বাসনের ফলাফল—এসব নিরপেক্ষভাবে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে হবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক মাদক প্রবাহের রুটও নজরে রাখতে হবে।

মাদক সমস্যায় শুধু শাস্তি বা শুধু সহানুভূতি—দুটোই একা কার্যকর নয়। যারা মাদক ব্যবহারকারী, বিশেষ করে তরুণ, তাদের পুনর্বাসন ও সচেতনতার সুযোগ দিতে হবে। আর যারা বিক্রেতা বা সরবরাহকারী, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। নীতি ও বাস্তবতায় এই পার্থক্যটা স্পষ্ট করা জরুরি।

শিক্ষক হিসেবে আমরা যদি প্রতিদিন ক্লাসের আগে বা শেষে কয়েক মিনিট শিক্ষার্থীর খোঁজ নিই—“তুমি কেমন আছো?”, “কোনো চাপ অনুভব করছো?”—এগুলো শিক্ষার্থীর আস্থা বাড়াবে। সহপাঠীর আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন দেখলে তাকে নীরবে সমর্থন দিতে শেখাতে হবে। অভিভাবকদের উচিত হবে সন্তানকে স্বীকৃতি ও মানসিক সহযোগিতা দেওয়া, ‘নিখুঁত হতে হবে’—এমন চাপ না দেওয়া। প্রশাসনেরও দায়িত্ব হবে নীতিতে মানবিকতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা।

শেষ কথা—বিশ্ববিদ্যালয় হলো দেশের ভবিষ্যতের কারিগর। যদি আমরা এই নীরব আগুন—মাদকতা—নেভাতে না পারি, তবে হারাবো শুধু একটি প্রজন্ম নয়, হারাবো দেশের উন্নয়নের স্বপ্ন। তাই সহমর্মিতার সঙ্গে কঠোর আইন প্রয়োগ, গবেষণাভিত্তিক নীতি, আর সবার সমন্বিত উদ্যোগই পারে বিশ্ববিদ্যালয়কে এমন জায়গায় পরিণত করতে—যেখানে মাদকের জায়গা নেই, আছে কেবল আশা, জ্ঞান আর উন্নয়নের আলো।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ডেইলি অবজারভার




LATEST NEWS
MOST READ
Also read
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000.
Phone: PABX- 41053001-06; Online: 41053014; Advertisement: 41053012.
E-mail: [email protected], news©dailyobserverbd.com, advertisement©dailyobserverbd.com, For Online Edition: mailobserverbd©gmail.com
🔝
close