Thursday | 23 October 2025 | Reg No- 06
Epaper | English
   
English | Thursday | 23 October 2025 | Epaper
BREAKING: সাইফ ও সৌম্যর রেকর্ড জুটিতে ২৯৭ রানের লক্ষ‍্য দিল বাংলাদেশ      দেশকে এগিয়ে নিতে নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন: মির্জা ফখরুল      টস জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ      সহজেই জয় পেল অস্ট্রেলিয়া      ইসরায়েলের পার্লামেন্টে পশ্চিম তীর দখলের বিল পাস      জেনেভা ক্যাম্পে দু'গ্রুপের সংঘর্ষে যুবক নিহত      কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি জামায়াতের, জানালেন প্রধান উপদেষ্টাকে      

রক্তমাখা কলম ও নিথর সংবাদ: নিরুপায় গণমাধ্যমের আকুতি শুনবে কে?

Published : Monday, 11 August, 2025 at 6:59 PM  Count : 146

একটি রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে টঙ্গীর একটি গলিতে। চারপাশ নিঃস্তব্ধ, বাতাস থমকে গেছে, আর পিচঢালা পথ ভিজে উঠেছে লাল রক্তে। এই দৃশ্য কোনো অপরাধ চলচ্চিত্রের দৃশ্য নয়, এটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম ইতিহাসের আরেকটি করুণ অধ্যায়। নাম তাঁর তুহিন মাহমুদএকজন সাংবাদিক, এক সংগ্রামী কণ্ঠস্বর, যে কলম হাতে তুলে নিয়েছিল সমাজের অন্ধকার গলির দিকে আলোর তীর ছুঁড়ে দিতে।


তাঁর অপরাধ? সত্য বলা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম চালানো। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুকে প্রশ্ন করা।


তুহিন মাহমুদ, দৈনিক গাজীপুর সংবাদ-এর নির্ভীক রিপোর্টার, ২০২৫ সালের ৬ আগস্ট রাতে নির্মমভাবে খুন হলেন। একটি জনপথে, প্রকাশ্য গলিতে ছুরিকাঘাতে তাঁর জীবন শেষ করা হয়। কোনো রাজনৈতিক বিক্ষোভ, কোনো সংঘর্ষ বা সন্ত্রাস নয়এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে একেবারে পরিকল্পিতভাবে, যেন কেউ চায়নি সত্য তার কণ্ঠে উচ্চারিত হোক।


সাংবাদিকতা: পেশা নাকি প্রাণত্যাগের প্রতিজ্ঞা?


বাংলাদেশে সাংবাদিকতা আজ আর শুধু পেশা নয়এটি একপ্রকার আত্মাহুতি, এক যুদ্ধ যার অস্ত্র কেবল একটি কলম আর একটি নোটবুক। তুহিনের হাতে ছিল না কোনো বন্দুক, ছিল না কোনো প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিচয়ছিল কেবল সাহস, সততা আর সমাজকে জানার ও জানানোর আগ্রহ। তার এই মৌলিক অধিকারই তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।


এ এক রক্তাক্ত বাস্তবতাযেখানে সংবাদ সংগ্রহ মানে শুধু তথ্য নয়, কখনো কখনো নিজেকে উৎসর্গ করার আর্তি। আর এই বাস্তবতা নতুন কিছু নয়। ১৯৯৪ সালে সাংবাদিক গৌতম দাসের মৃত্যু, ২০০৪ সালে গুলশানে জামাল উদ্দিনের গুম হওয়া, ২০১২ সালের সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, ২০১৭ সালে সিরাজগঞ্জে শিমুল হত্যাকাণ্ডপ্রতিটি ঘটনাই বলে দেয়, এ পেশা আজ এক ক্রমাগত ঝুঁকির পথে হাঁটছে।


রক্তাক্ত পরিসংখ্যান: নাম নয়, সংখ্যা নয়মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে


তুহিনের মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হন অন্তত ১৩৬ জন। এদের মধ্যে গুরুতর আহত হন ৭ জন, নিহত হন ২ জন। ২০২৩-২৪ সালে "ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন"-এর আওতায় মামলা দায়ের হয় ২৭৪টি। অধিকাংশ মামলার বাদী ক্ষমতাসীন দলের নেতা কিংবা প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ কেউ।


জাতীয় প্রেস ক্লাব ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, সাংবাদিক নির্যাতনের মামলার মাত্র ৫ শতাংশে চার্জশিট গঠিত হয় এবং বিচারিক নিষ্পত্তি হয় মাত্র ২ শতাংশেরও কম মামলায়।


সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড আজও বিচারহীন। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাঁদের বাসায় নৃশংসভাবে খুন করা হয়। আজ ১৩ বছর পরও সেই মামলা ঝুলে আছে। তদন্তের নামে চলছে প্রহসন, পরিবর্তন হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা, তদন্ত সংস্থা, কিন্তু পরিবর্তন হয়নি রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা।


তুহিনের ঘটনাও কি সেই একই ধারার পুনরাবৃত্তি হবে?


রাষ্ট্রের ভূমিকা: নীরবতা না ব্যর্থতা?


একটি রাষ্ট্র তখনই সভ্যতার দাবিদার হতে পারে, যখন সে তার নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেবিশেষ করে যারা রাষ্ট্রের অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রকাশ করে। কিন্তু যখন সাংবাদিক খুন হয়, আর রাষ্ট্র কেবল একটি “দ্রুত তদন্ত হবে” বিবৃতি দিয়ে দায় সারেতখন বোঝা যায়, এই রাষ্ট্র নিজের চতুর্থ স্তম্ভকে রক্ষা করতে চায় না।


রাষ্ট্র যদি সাংবাদিক হত্যার বিচার না করে, তবে তা কেবল বিচারহীনতারই প্রতিচ্ছবি নয়, এটি আসলে একটি অবৈধ নীরব অনুমোদন। কারণ এই নীরবতা, এই দীর্ঘসূত্রতা, এই 'তদন্ত চলছে'র অজুহাত, সবই এক অদৃশ্য কাঠামোর ইঙ্গিত দেয়যেখানে ক্ষমতা চায় না কেউ তাদের অপরাধ ফাঁস করুক।


নীরবতা কি সম্মতির নাম?


সাংবাদিক তুহিন মাহমুদের মৃত্যুর পর সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু হ্যাশট্যাগ দেখা গেলেও, অধিকাংশ সাংস্কৃতিক সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ ছিল নীরব। কোনো তীব্র প্রতিক্রিয়া, ধারাবাহিক প্রতিবাদ বা জনমত গড়ে তোলার ইচ্ছাও দেখা যায়নি।


সাংবাদিকতা যদি সমাজের দর্পণ হয়, তবে সেই দর্পণের ভাঙা প্রতিচ্ছবিতে সমাজের বিবেকও প্রতিফলিত হয়। চুপ থাকা কি সম্মতি নয়? যদি আমরা এই মৃত্যুর প্রতিবাদ না করি, তবে আমরা কিসের নাগরিক?


ড. গওহার রিজভীর মত বিশিষ্টজনেরা বহুবার বলেছেন, “সংবাদপত্র রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। যদি এ স্তম্ভ ভেঙে পড়ে আর রাষ্ট্র নীরব থাকে, তবে রাষ্ট্র তার আত্মমর্যাদা হারায়।” কলামিস্ট মাহফুজ আনামের মতে, “সাংবাদিক হত্যা মানে কেবল একটি জীবনহানি নয়এটা সমাজের বিবেক হত্যা।”


অতীত থেকে বর্তমান: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি


সাগর-রুনি, গোলাম মাহমুদ, জামাল উদ্দিন, শিমুল, গৌতম দাস, দিপ্ত নাথ, আবুল হোসেনএইসব নামেরা শুধু মানুষের নাম নয়, তারা সাংবাদিকতা নামক একটি পেশার শহীদ। কেউকে গুম করা হয়েছে, কেউকে গুলি করে মারা হয়েছে, কেউ নিখোঁজ হয়েছে বছরের পর বছর, আর কেউ নির্যাতনের শিকার হয়ে পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে।


তাঁদের পরিবারের কান্না, সন্তানদের অসহায়তা, সহকর্মীদের আতঙ্কএসব মিলে গড়ে উঠেছে এক করুণ প্রেক্ষাপট, যা বলে দেয়: বাংলাদেশে সত্য বলা মানেই ঝুঁকি নেওয়া, কখনো কখনো জীবনের ঝুঁকি।


একটি নির্যাতিত পেশা: ভেতরের সংকট


সাংবাদিকতা কেবল বাইরের হুমকির মধ্যেই আবদ্ধ নয়ভেতরেও রয়েছে গভীর সংকট। অনেক সাংবাদিক প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা পান না, মালিকপক্ষ নির্লিপ্ত থাকে, সাংবাদিক সংগঠনগুলো বিভক্ত, আর একে অপরের বিপরীতে অবস্থান করে।


মিডিয়া হাউজগুলোর বড় অংশই রাজনৈতিক আনুগত্যে পরিচালিত। ফলে সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব চাপে পড়ে যায়। কেউ রিপোর্ট করতে গিয়ে চাকরি হারায়, কেউ হুমকি পায়, আবার কেউ চুপ করে থাকার বিনিময়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।


অপরদিকে, সাংবাদিকতায় প্রবেশ করা অনেকেই প্রশিক্ষণহীন, গবেষণাবিমুখ ও দায়িত্বহীন হওয়ায় পেশার সার্বিক মানও কমছে। ফলে প্রকৃত সংবাদযোদ্ধারা হয়ে পড়ছেন কোণঠাসা।


সমাধানের পথ: কেবল শোক নয়, প্রতিরোধ চাই


১. সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন: সাংবাদিকদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ও বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা জরুরি।

২. স্বাধীন তদন্ত কমিশন: সাংবাদিকদের উপর হামলার ক্ষেত্রে পুলিশের বাইরে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।

৩. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংস্কার: মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এই আইনের অপব্যবহার রোধে ধারাসমূহ পুনর্বিবেচনা করা দরকার।

৪. মিডিয়া হাউজের দায়বদ্ধতা: সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপত্তা, আইনি সহায়তা ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

৫. সংগঠনের ঐক্য: সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলে ধারাবাহিক আন্দোলন, জনমত সৃষ্টি ও নীতিনির্ধারণে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

৬. সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতা: নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ, নৈতিকতা ও মানবাধিকার বিষয়ক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।


ইতিহাস কি আমাদের ক্ষমা করবে?


তুহিন মাহমুদ শুধু একজন সাংবাদিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক প্রতীকসত্য বলার সাহসিকতার প্রতীক। তাঁর মৃত্যুতে যদি আমরা শুধু কয়েকটা পোস্ট দিই, শোক জানাই, প্রতিবাদ না করিতাহলে ইতিহাস আমাদেরও ক্ষমা করবে না। আমরা হবো সেই নীরব দর্শক, যারা একটি বিবেক হত্যার সময় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।


তুহিন আমাদের কলম বন্ধ করে যেতে বলেনি। সে বলে গেছেসত্য বলা বন্ধ করো না, প্রতিবাদ থামিও না, কারণ আমরা থেমে গেলে অন্যায় আরও বেপরোয়া হবে।


তাহলে বলুন, আমরা কী করবো? কলম নামিয়ে রাখবো? নাকি সেই রক্তমাখা কলম আবার তুলে নেবো? আমাদের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবেআমরা কেমন দেশ চাই, কেমন সমাজ গড়তে চাই।


তুহিনের প্রশ্ন আজও বাতাসে ভাসে—“একজন সাংবাদিক কার কাছে চাইবে নিরাপত্তা?”


এই প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা এখন না খুঁজি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ ইতিহাসে লেখা থাকবে: এক নির্লজ্জ, নির্বিকার, আত্মবিক্রীত সমাজের গল্প।


মো: মাজেম আলী মলিন,

সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,

রোজী মোজাম্মেল মহিলা অনার্স কলেজ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



LATEST NEWS
MOST READ
Also read
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000.
Phone: PABX- 41053001-06; Online: 41053014; Advertisement: 41053012.
E-mail: [email protected], news©dailyobserverbd.com, advertisement©dailyobserverbd.com, For Online Edition: mailobserverbd©gmail.com
🔝
close