নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের বিলহরিবাড়ি গ্রাম। চলনবিলের বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা এক দীর্ঘশ্বাসের নাম। যেন সময় থমকে আছে কাঁদায়, আর স্বপ্নগুলো ভেসে বেড়ায় নৌকার ভেলায়। এই গ্রামের মানুষের জীবনের গল্পটা শুরু হয় জলমগ্ন পথ দিয়ে, আর শেষ হয় নদীর বুকের মাঝখানে নৌকার অপেক্ষায়।
প্রায় ২৫ হাজার মানুষের বাস এই জনপদে। ভাটিতে রাবার ড্যাম থাকায় বছরের আট মাস নদী থাকে টইটম্বুর, আর বাকি সময়েও হাঁটু থেকে কোমর পানির মধ্য দিয়েই শিশুদের পাড়ি জমাতে হয় স্কুলে, বাজারে কিংবা জরুরি চিকিৎসার সন্ধানে। শুধু একটি খেয়া নৌকাই তাদের ভরসা। নৌকায় ওঠার সময় কচি হাতে বই-খাতা ভিজে যায়, কখনও দুর্ঘটনায় প্রাণও হারায়- তবু থেমে থাকে না পথচলা।
শুক্রবার সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, এ গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে মাত্র একটি। উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ৫ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয়। কখনও হাঁটু কাঁদা পেরিয়ে, কখনও কোমর পানি সাঁতরে। এ যেন স্বপ্নের পিছু ছুটে হয় প্রতিদিন যুদ্ধ করে।
তবুও এলাকাবাসীর মনে আশার আলো জেগেছিল ২০২৩ সালের ০৮ জুন। প্রয়াত সংসদ সদস্য আবদুল কুদ্দুসের সহায়তায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) আত্রাই নদীর ওপর সাবগাড়ী বাজার সংলগ্ন স্থানে একটি সেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছিলেন। ব্যয় ধরা হয় ১০ কোটি ১৫ লাখ ৩৭ হাজার ৪৫৫ টাকা। এলাকাবাসীর চোখে তখন এক নতুন স্বপ্ন: কাঁদা-নৌকা পেরিয়ে নয়, এবার পাঁকা সেতু দিয়ে নিরাপদে চলবে যাতায়াত, স্কুলগামী শিশুরা হাসিমুখে পৌঁছাবে গন্তব্যে, কৃষকের ফসল বাজারে যাবে সোজা পথে।
কিন্তু সেই স্বপ্ন যেন আবারও আটকে গেল কাঁদায়। দুই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সেতুর কাজ এগিয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মীর হাবিবুল আলমকে ২০২৫ সালের ২৮ মে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও, আজ অবধি নেই কোনো সাড়া।
৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী মারিয়া বলে, “প্রতিদিন কাঁদা মাড়িয়ে আর নৌকা পার হয়ে স্কুলে যাই। অনেক সময় নৌকা উল্টে গেলে বই খাতা ভিজে যায়। মনে হয়, আমরা কি বাঁচবো?”
একই ভাবে হতাশা ব্যক্ত করেন স্থানীয় চিকিৎসক ডা. মো. আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, “রাস্তাঘাটের বেহাল দশার কারণে জরুরি রোগী নিয়ে হাসপাতাল পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিপণ্য পরিবহনও ব্যাহত হচ্ছে। যদি এই গতি থাকে, আগামী ১০ বছরেও সেতু শেষ হবে না।”
এখানকার কৃষকরা শোকাহত কণ্ঠে বলেন, বর্ষায় ক্ষেতের ফসল তুলতে পারি না, শুষ্ক মৌসুমে বাজারে নিতে গিয়ে হিমশিম খাই। চিকিৎসার অভাবে রোগী কষ্ট পায়, মৃতদেহ কবরে নেওয়ার পথটিও কর্দমাক্ত শুধু এই সেতুটির জন্য। সেতুর কাজটি শেষ হলেই সড়ক নির্মাণ কাজ সহজ হতো।
মুঠোফোন বন্ধ থাকায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
গুরুদাসপুর উপজেলা প্রকৌশলী মো. মিলন মিয়া বলেন, “কাজের অগ্রগতি না থাকায় ও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে শিগগিরই নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করে সেতুর কাজ শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”
এই গ্রাম যেন উন্নয়নের মানচিত্রে একটি উপেক্ষিত নাম, যেখানে রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু বাস্তবতা দাঁড়িয়ে থাকে পায়ের কাঁদায়। বিলহরিবাড়ির মানুষের চোখে এখনো প্রতীক্ষার জল, তারা চায় না স্রেফ একটি সেতু- তারা চায় মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার সুযোগ।
এমএ