কুড়িগ্রামের তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলজুড়ে নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রতিদিন প্রকট হয়ে উঠছে। রাজারহাট, রৌমারী ও উলিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত চরগুলোতে নারীরা এখনও আধুনিক চিকিৎসা, নিরাপদ মাতৃত্ব ও স্বাস্থ্য সচেতনতা থেকে অন্ধকারেই পড়ে রয়েছে।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট, রৌমারী ও উলিপুরের চরগুলোতে নেই পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য কেন্দ্র, নেই নারীবান্ধব অবকাঠামো। এছাড়া সচেতনতার অভাবে প্রতিনিয়তই বাড়ছে রোগব্যাধি। কাছে পিঠে নেই হাসপাতাল, নেই নার্স। স্বাস্থ্যসেবা নিতে হলে পাড়ি দিতে হয় কয়েক মাইল পথ। চরে বালু পেরিয়ে কিংবা বন্যার সময় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়া যেন এক বিশাল যুদ্ধ। এই বিড়ম্বনার গল্প যেন চরের পড়তে পড়তে লেখা।
চরাঞ্চলে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন গর্ভবতী নারীরা। এখানকার নারীরা গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন সময়কে ‘ভয়ানক সময়’ হিসেবে বর্ণনা করেন। এখানে নেই কোনো স্থায়ী কমিউনিটি ক্লিনিক। স্বাস্থ্যকর্মীও চর এলাকায় নিয়মিত পৌঁছাতে পারেন না। ফলে অধিকাংশ প্রসব হয় ঘরে, স্থানীয় ‘দাই’-এর মাধ্যমে, যা প্রায়শই জটিলতায় পড়ে।
রাজারহাটের ঘড়িয়াল ডাঙ্গার বগুড়া পাড়ায় দুই বছরের শিশু আমিনকে নিয়ে মা পারভীন বলেন, ‘যখন আমিন হয় তখন চরত পানি উঠছিল। ঘড়-বাড়ি সোগে পানিত ডুবি গেচলো। আইত (রাত) থাকি প্যাটের বিষ। পরের দিনা দোপরে নৌকাত করি স্বাস্থ্য কেন্দ্রত নিয়া গেইচে। যায়্যা (গিয়ে) ফির ডাক্তার নাই। তারপরে নার্সেরা স্যালাইন দিয়া পরে নরমালে বাচ্চা হইছে।’
উলিপুরের বজরা ইউনিয়নের ফকিরের চরের বাসিন্দা রজব আলী বলেন, ‘বাড়িত নরমালে প্রসবের জন্য দাই ডাকে আনছি। কিন্তু প্রসবের সময় আমার বউয়ের খুব রক্তপাত শুরু হয়। ওই সময় হাসপাতালত নিয়্যা যামো (নিয়ে যাবো) কোনো ব্যবস্থা নাই। ঘোড়ার গাড়িও আশেপাশে আচিল না। শেষে অর্ধেক রাস্তা চটের বস্তা দিয়া টানি নিয়া গেছি। নদীর পাড়ত যায়্যা (গিয়ে) দেখি নৌকাও নাই। পরে অনেক কষ্টে বাঁচানো গেছে।
চরাঞ্চলের নারীরা ঋতুকালীন সময়, ইনফেকশন ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা নিয়ে এখনো ট্যাবু। ঋতুকালীন সময়ে নারীরা স্যানিটারি প্যাডের পরিবর্তে পুরানো কাপড় ব্যবহার করেন। যেগুলো অনেক সময় অপরিষ্কার অবস্থায় ব্যবহার হয়। ফলে ইউরিন ইনফেকশন, স্কিন ডিজিজ ও গোপন রোগের জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাজারহাটের রগুড়াপাড়া চরের এলাকার কিশোরী মিনতি জানায়, “আমাদের এলাকায় দোকানে প্যাড পাওয়া যায় না। আবার এসব নিয়ে কথা বলাও লজ্জার। আবার কিনতে টাকা লাগে। এ জন্য পরিবারও কিনে দিতে চায়না।”
ডায়রিয়া, চর্মরোগ ও অপুষ্টি- প্রতিদিনের সঙ্গী নিরাপদ পানির অভাব ও অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থার কারণে নারীরা প্রতিনিয়ত ডায়রিয়া, পেট ব্যথা, চর্মরোগে ভুগছেন। বর্ষা মৌসুমে এই সমস্যা চরম আকার ধারণ করে। অধিকাংশ নারী অপুষ্টিতে ভোগেন। গর্ভবতী নারীরা পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়ায় রক্তশূন্যতা, দুর্বলতা ও শিশুর ওজনহীনতার সমস্যায় ভোগেন।
পরিসংখ্যান বলছে, চরাঞ্চলে গর্ভাবস্থায় গর্ভকালীন চিকিৎসা পান ৩০ শতাংশ নারী, ঘরে প্রসব হয় ৭০ শতাংশ, ১৫ শতাংশ নারী স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন। নারীর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা খুবই কম (প্রায় অনুপস্থিত)। নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দূরত্ব গড়ে ৫-১০ কি. মি.।
সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে আসছে লাইট হাউজ নামে একটি সংগঠন। সংগঠনটির রাজার হাট কো-অর্ডিনেটর অঞ্জলি রানী বলেন, “চরাঞ্চলের নারীদের জন্য চরভিত্তিক ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যসেবা (নৌকাভিত্তিক ক্লিনিক), গর্ভবতী নারীদের জন্য বিনামূল্যে পুষ্টিকর খাবার ও আয়রন ট্যাবলেট, মাসিক স্বাস্থ্য ও প্যাড ব্যবহার নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার, প্রশিক্ষিত দাই ও প্রসবকালীন নিরাপদ সেবা কেন্দ্র, চরে অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।”
কুড়িগ্রাম স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোদাব্বের হোসেন বলেন, “চরাঞ্চলে আমাদের পৌঁছাতে সমস্যা হয়- নদীপথ, কাঁচা রাস্তা ও জনবল সংকট কারণে স্বাস্থ্য সেবা নিয়মিত দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু পার্শ্ববর্তী যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে সেগুলোতে দিন-রাত সেবা দেয়া হয়।”
কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে নারী স্বাস্থ্য একটি নীরব দুর্যোগ। রাষ্ট্রের দৃষ্টি এদিকে আরও নিবদ্ধ না হলে নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি শুধু বাড়বে না, যা পরোক্ষ ভাবে পুরো সমাজকে দূর্বল করবে। তাই এখনই সময় চরাঞ্চলের নারীদের জন্য কার্যকর স্বাস্থ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের- এমনটাই মনে করছেন কুড়িগ্রামের সচেতন মানুষ।