নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিষা ইউনিয়নের সিধুলী বাজারে মাদ্রাসার নামে দীর্ঘদিন ধরে জোরপূর্বক অর্থ আদায়ের অভিযোগে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় একটি বেসরকারি কওমি মাদ্রাসার রসিদ বই ব্যবহার করে কিছু ব্যক্তি নিয়মিতভাবে দোকানিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছিলেন বলে জানা গেছে। বিষয়টি সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে ফাঁস হয়ে গেলে জনমনে ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বাজারটিতে কোনো সরকারি খাজনা নির্ধারিত না থাকলেও একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী প্রতিটি দোকান থেকে মাসে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ‘খাজনার’ নামে অর্থ আদায় করছিল। টাকা না দিলে দোকানে ব্যবসা করতে দেওয়া হতো না বলেও অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও অর্থ আদায়ের জন্য মাদ্রাসার রসিদ ব্যবহার করা হতো, তবুও এর কোনো হিসাব বা ব্যাখ্যা কখনো দেওয়া হয়নি।
ব্যবসায়ীদের আরও অভিযোগ, বাজার পরিচালনার জন্য কোনো সরকারি অনুমোদিত কমিটি না থাকা সত্ত্বেও কিছু লোক নিজেদের ‘বাজার কর্তৃপক্ষ’ দাবি করে দীর্ঘদিন ধরে এভাবে অর্থ আদায় করে আসছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দোকানি বলেন, "রসিদে লেখা থাকলেও টাকা দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। না দিলে দোকান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি আসত।"
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয়দের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনের নজরে আসে। পরে, ১৪ এপ্রিল সেনাবাহিনীর একটি টহল দল স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে বাজারে অভিযান চালায়। অভিযানে অর্থ আদায়ের রসিদ, রসিদ বইসহ বিভিন্ন প্রমাণ জব্দ করা হয় এবং অভিযুক্ত কয়েকজনকে আটক করে থানায় সোপর্দ করা হয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৬ এপ্রিল (বুধবার) সকাল সাড়ে দশটার দিকে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় কিছু ব্যক্তি গুরুদাসপুর থানার সামনে ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন। তারা নির্দোষদের মুক্তি ও প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতারের দাবি জানান। বক্তারা বলেন, “আমরা চাই প্রকৃত দোষীরা সাজা পাক, কিন্তু নির্দোষ কাউকে হয়রানি করা যাবে না। না হলে দুর্বার আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।”
গুরুদাসপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম সারোয়ার বলেন, “সেনাবাহিনীর অভিযানের পর কয়েকজনকে আটক করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা মাদ্রাসার রসিদ ব্যবহার করে অর্থ আদায়ের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা আফরোজ বলেন, “সিধুলী বাজারে খাজনা আদায়ের কোনো সুযোগ নেই, কারণ জায়গাটি স্থানীয় স্কুলের মালিকানাধীন। এটি সরকারি সম্পত্তি নয়। এলাকাবাসী এখানে কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে থাকেন। ফলে বাজার বন্ধ করে দেওয়ারও তাদের কোনো অধিকার নেই। তারপরও যদি কেউ বেআইনিভাবে অর্থ আদায় করে, তা আইন লঙ্ঘনের শামিল। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি এবং প্রমাণ মিললে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
স্থানীয় প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, যাঁরা ‘বাজার কমিটির’ নামে অর্থ আদায় করছিলেন, তাঁরা কেউই সরকার স্বীকৃত বাজার কমিটির সদস্য নন। অপরদিকে, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা সরাসরি অর্থ আদায়ে জড়িত নন; তবে তাদের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য ব্যক্তিগতভাবে অর্থ সংগ্রহ করছিলেন বলে জানা গেছে।
সচেতন নাগরিকরা বলছেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার এ ধরনের প্রতারণা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তারা দ্রুত তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
এ প্রসঙ্গে এলাকাবাসীর আশঙ্কা—সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে সাময়িকভাবে অর্থ আদায় বন্ধ হলেও, স্থায়ী সমাধান না হলে বাজারটি ভবিষ্যতে আবারও অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হতে পারে। এজন্য তাঁরা সরকারি নিয়ন্ত্রণে একটি স্বচ্ছ, স্বীকৃত বাজার পরিচালনা কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন।
এমএ/আরএন