জন্মের পর মায়ের কোলে উঠতে পারেনি নবজাতক। পৃথিবীতে আসার মাত্র আধা ঘণ্টা পরই শিশুটিকে অন্যের হাতে তুলে দেন বাবা ও মা। বিনিময়ে মিলল কিছু টাকা ও চাল- এই দিয়েই চলে তাদের সংসার।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার বুড়িশ্বর ইউনিয়নের শ্রীঘর গ্রামের মোহাম্মদ আলী (লালন) ও তার স্ত্রী মারুফা বেগম, দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিদিন যুদ্ধ করা এমন এক দম্পতি। জীবনের তীব্র অভাব আর ক্ষুধার কাছে হার মেনেই একের পর এক সন্তান বিক্রি করেছেন তারা।
লালনের কণ্ঠে হতাশার সুর- “কাছা থাকতেই দেলাইছলাম পুলাডারে। মায়ের বুকের দুধ খাওয়াইবার টাইমও দিছে না। কথা যখন দেলাইছি, আর কিছু কইতামও পারি না। অহন পোলাডা কই আছে, কার কাছে আছে- তা অই জানি না।'
১০ বছরের দাম্পত্য জীবনে লালন-মারুফার ঘরে এসেছে সাতটি সন্তান। বছর দেড়েক আগে ষষ্ঠ সন্তান জন্মের পর বিক্রি করেন তারা। সম্প্রতি জন্ম নেওয়া সপ্তম সন্তানকেও জন্মের মাত্র ১৪ দিনের মাথায় অন্যের হাতে তুলে দিয়েছেন। বিনিময়ে মিলেছে কিছু টাকা ও খাদ্যসামগ্রী।
লালনের কণ্ঠে কষ্টের ছোঁয়া, 'অতলা পুলাপান লইয়া ত আর চলতাম পারি না। খাওন দিতাম পারি না। তবে আমি পুলাপান বেচি না। যারা নে, হেরা খুশি হইয়া যা দে, তা অই রাহি। এবার দিবার সময় কাগজ কইরা দিছি, যাতে মাঝে মাঝে পুলাডারে দেখতাম পারি। হুনছি হেরা ডাহা লইয়া গেছে গা।'
দারিদ্র্যের আঁধারে তাদের জীবন যেন এক দুঃখগাথা। টিনের ভাঙাচোরা ছোট্ট ঘরই একমাত্র আশ্রয়। নিজের কোনো জমি নেই, নেই সম্পদও। প্রতিবেশী সোলেমান মিয়ার পরিত্যক্ত একটি ঘরেই সংসার গড়েছেন তারা।
দুপুরের সূর্যের আলো ঘর ভেদ করে ঢুকে পড়ে, আর বৃষ্টি নামলেই চুইয়ে পড়ে পানি। ঘরে আসবাব বলতে দুটি পাতিল আর কিছু পুরানো কাপড়। বাজার থেকে কুড়িয়ে আনা পুঁটি মাছের ঝোল আর ভাত- এতেই চলে সংসার।
মারুফা ভিক্ষা করেন, বড় সন্তানদের দিয়েও করান ভিক্ষা। তবু ক্ষুধা মেটে না।
মারুফা বলেন, 'নিজের বাড়ি নাই। আরেকজন জাগা দিছে। এলাকার মাইনসে ঘর তুইল্লা দিছে। মাডির মইদ্দেই আমডা গুমাই। বাইরে চুলায় রান্দি, ঘরে আইন্না খাই। অতলা পুলা মায়া জহন কষ্ট ত করণ অই লাগবো, ত খারাপ লাগে বৃষ্টি আইলে।'
বর্তমানে তাদের ঘরে পাঁচ সন্তান আছে। বড় মেয়ের বয়স আট বছর, মাঝে মাঝে স্কুলে যায়। বাকিরা এখনো কথা বলা শিখছে।
স্থানীয়রা জানান, পরিবারটি চরম অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সন্তান বিক্রির খবর জানলেও কেউ উদ্যোগ নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে তাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি।
দুঃখ, ক্ষুধা ও বঞ্চনার মধ্যেও লালন-মারুফা আঁকড়ে আছেন জীবনের শেষ আশ্রয়- তাদের বেঁচে থাকা সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা।
তবু প্রশ্ন থেকে যায়- দারিদ্র্যের কাছে হার মেনে কবে পর্যন্ত সন্তান বিক্রি করে টিকে থাকবে এই পরিবারটি?
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহিনা নাসরিন বলেন, 'ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। ১০ বছরের সংসারে সাতটি সন্তান বর্তমানে তাদের কাছে আছে পাঁচটি। পর পর দুটি শিশু তারা বিক্রি করেছেন। তাদের কোনো জায়গা-জমি, শিশুদের চিকিৎসা করানোর মত কোনো সামর্থ্য নেই, আর্থিক অনটনের কারণেই করে থাকতে পারে, তাদের জন্য প্রাথমিক ভাবে চাল, ডাল, তেল এবং পরিধেয় বস্ত্র দেওয়া হয়েছে। আশ্রয় প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ এবং প্রতিদিনের ইনকামের জন্য একটি রিকশার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপরও আরও ভালো ভাবে পুনর্বাসন করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়তায় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এসআর/এমএ