পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাসীদের সংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি। প্রবাসী বাংলাদেশিদের নির্বাচনে ভোট দিতে পারার বিষয়টি দীর্ঘ প্রত্যাশিত হলেও তাদের ভোটের আওতায় আনা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সময়ে প্রবাসীদের জন্য ভোটের ব্যবস্থা (যেমন- পোস্টাল ভোট, দূতাবাসে ভোট, ইলেকট্রনিক/অনলাইন ভোট) চালুর দাবি উঠেছে, কিন্তু কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
তবে এ নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে আলোচনা কম হয়নি। গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আবারো এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। প্রবাসীরা যাতে জাতীয় নির্বাচন ভোট দিতে পারেন, তা নিয়ে নানামুখী কাজ চলছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালট ভোটিং পদ্ধতি অকার্যকর বলে মনে হয়েছে তাদের কাছে। এ বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন দুটি পদ্ধতির প্রস্তাব করেছে (১) তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা সূচক পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থা (২) অনলাইন ইন্টারনেট ভোটিং ব্যবস্থা। এই দুটি পদ্ধতির পাশাপাশি প্রক্সি ভোটিং পদ্ধতিকেও আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো জনগণের অংশগ্রহণ। একটি দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ভোটাধিকার। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে, বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক প্রবাসী নাগরিক এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা ভোটার তালিকায় থাকলেও বাস্তবে ভোট দিতে পারেন না। এই পরিস্থিতি একটি গুরুতর গণতান্ত্রিক শূন্যতার সৃষ্টি করেছে, যার সমাধান সময়ের দাবি।
প্রবাসীদের গুরুত্ব
বর্তমানে প্রায় দেড় কোটিরও বেশি বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। তারা শুধু দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবেই নয়, সমাজ-সংস্কৃতি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স প্রেরণ করে তারা দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছেন। কিন্তু এমন জনগোষ্ঠী যদি দেশের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে না পারে, তাহলে তা একটি বড় গণতান্ত্রিক সংকট হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত।
ভোট দিতে না পারার কারণসমূহ
আইনগত সীমাবদ্ধতা: বর্তমান নির্বাচনী আইনে প্রবাসীদের জন্য আলাদা করে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। আইনে ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্তি থাকলেও দেশের বাইরে অবস্থানরত ভোটারদের ভোট প্রদান নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা বা ব্যবস্থাপনা নেই।
কারিগরি ও প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ: অনলাইন বা ই-ভোটিং ব্যবস্থার অভাব এবং নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ এ ব্যবস্থার বাস্তবায়নকে ব্যাহত করছে। ভোটার শনাক্তকরণ, তথ্যের গোপনীয়তা ও জালিয়াতির আশঙ্কাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রশাসনিক অদক্ষতা ও সমন্বয়ের অভাব: প্রবাসীদের ভোটার তালিকা হালনাগাদ, পাসপোর্ট ও এনআইডি তথ্য যাচাই, দূতাবাসের সাথে সমন্বয়সহ নানা প্রশাসনিক কাজের ঘাটতি রয়েছে।
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব: প্রবাসীদের ভোট কোন দলকে লাভবান করবে, তা নিশ্চিত না হওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে পর্যাপ্ত আগ্রহ নেই বলেই মনে হয়।
সমাধানের পথ
নতুন আইন প্রণয়ন: সংসদে একটি সুনির্দিষ্ট ‘প্রবাসী ভোট আইন’ পাস করা দরকার, যেখানে ই-ভোটিং, পোস্টাল ভোট কিংবা দূতাবাস কেন্দ্রীক ভোটের বিধান থাকবে।
পাইলট প্রকল্প চালু: যেসব দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা বেশি (যেমন- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ইউকে), সেখানে পরীক্ষামূলক ভাবে অনলাইন বা দূতাবাস কেন্দ্রীক ভোটিং ব্যবস্থা চালু করে বাস্তবতা যাচাই করা যেতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের সক্রিয় উদ্যোগ: ইসি যদি প্রবাসীদের ভোটাধিকারের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করে, তাহলে তা রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং ব্যাপক আলোচনা তৈরি করবে।
প্রবাসীদের তথ্য হালনাগাদ ও সচেতনতা বৃদ্ধি: প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকে একত্রে কাজ করে প্রবাসীদের ভোটার তথ্য হালনাগাদ ও সচেতনতা কর্মসূচি চালাতে হবে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা গ্রহণ: অনেক দেশ যেমন- ভারত, ফিলিপাইন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ইতিমধ্যে প্রবাসীদের ভোটদানের সুবিধা চালু করেছে। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশেও উপযোগী মডেল তৈরি করা সম্ভব।
এদিকে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন ইসি এরই মধ্যে পোস্টাল ব্যালটের প্রাথমিক কর্মপদ্ধতি সেরে ফেলেছেন। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে প্রচারণায় নামতে চায় ইসি।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সরকার বা নির্বাচন কমিশনের তরফে প্রবাসীদের ভোটদানের বিষয়টি নিয়ে প্রবল ইচ্ছার প্রতিফলন থাকলেও সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ তারেক আহমেদ বলেন, '২০২৬ এর ফেব্রুয়ারিতে দেশে সাধারণ নির্বাচন হলেও সেই নির্বাচনে প্রবাসীরা ভোট দিতে পারবেন এটা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।'
আবুধাবিতে জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সরকার খুব সিনসিয়ার প্রবাসীদের ভোটাধিকারের ব্যাপারে। আমাদের কাছ থেকে, আমাদের শুধু না আরও বেশ কয়েকটা দেশে সম্ভবত চিঠি পাঠানো হয়েছে। আমরা এটা কীভাবে করতে পারি, আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। এটা নিয়ে এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা সিদ্ধান্ত হলে আপনাদের জানাতে পারব, এটা আমরা কীভাবে প্রসিড করব। ফেব্রুয়ারিতে ইলেকশন, এখন ছয় মাসেরও কম সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে এটি করা যাবে এ ব্যাপারে আমি আপনাদের আশা দিতে পারছি না।’
ইসি কর্মকর্তারা জানান, গত ২৪ জুন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা তথ্য প্রযুক্তি প্রয়োগ কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ওপর ভিত্তি করে অ্যাডভাইজরি কমিটির আইটি বেইজড পোস্টাল ব্যালটে ভোট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে ভোট দিতে আগ্রহীদের পোস্টাল ব্যালট পাঠানো ও ভোট শেষে তা ফেরত আনার বিষয়ে ডাকবিভাগ, ফেডএক্স, ডিএইচএল প্রতিনিধিরাও বৈঠকে মতামত তুলে ধরেন।
ডাক বিভাগ থেকে জানানো হয়, সংস্থাটির ইএমএস/রেজিস্টার্ড সার্ভিসে একজন ভোটারের ব্যালট পেপার প্রবাসে পাঠানো এবং ফেরত আনতে ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা ব্যয় হতে পারে।
বেসরকারি প্রতিনিধিরা জানান, ১২ দিনের মধ্যে পোস্টাল ব্যালট প্রবাসে ভোটারের কাছে পাঠানো ও ভোট শেষে ফেরত আনা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে সিল করা খাম ভোটার ও ইসি প্রতিনিধি ছাড়া কেউ খুলবে না; তাদের নিজস্ব স্থানীয় প্রতিনিধি ভোটারের কাছে পোস্টাল ব্যালট পৌঁছাবে এবং ভোটারকে ফোন করে ভোট দেওয়ার পর ফেরত আনবে। এ জন্য একজন ভোটারের পোস্টাল ব্যালট আনা-নেওয়ায় সব মিলিয়ে ৪০-৪৫ ডলার খরচ হতে পারে। টাকার হিসাবে যা প্রায় পাঁচ হাজার।
গত ১৬ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রবাসী ভোটারদের ভোটদানের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। এরপরই এএমএম নাসির উদ্দিন কমিশন চলতি বছরের ০৮ এপ্রিল এই বিষয়ে ওয়ার্কশপের আয়োজন করে। সেখানে দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিও, বেসিস এবং বিভিন্ন সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে।
একই ধারাবাহিকতায় গত ২৯ এপ্রিল নির্বাচন ভবনে ‘প্রবাসী ভোটারদের জন্য ভোটিং সিস্টেম উন্নয়ন’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ওই সেমিনারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিবৃন্দ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদকবৃন্দ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় এ সংক্রান্ত অ্যাডভাইজরি কমিটিও গঠন করে ইসি। ইতোমধ্যে সমন্বিতভাবে প্রবাসীদের ভোটদান নিশ্চিত করতে ১৮টি দল অনলাইনের পক্ষে, ১৫টি দল পোস্টাল ব্যালটে এবং প্রক্সিকে সমর্থন জানিয়ে ইসিতে মতামত দিয়েছে আটটি দল।
প্রবাসীদের ভোট দিতে পারার বিষয়টি নিয়ে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলো পুরোদমে কাজ করছে জানিয়ে আরব আমিরাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ তারেক আহমেদ বলেন, 'বিশ্বের যে দেশগুলোতে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের প্রচলন আছে, সেই দেশগুলোর নিয়ম-কানুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রবাসীদের ভোটের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে ৩০০ সংসদীয় আসনের ব্যালট স্থাপন করতে হবে দূতাবাসে। বিষয়টি বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকটা জটিল।'
তিনি বলেন, 'আমাদের জন্য কাজটা খুব একটা সহজ না। আমাদের ৩০০টা কনস্টিটিউন্সি। আমিরাতের অনেক বড় জনগোষ্ঠী এখানে থাকে প্রায় ১২ লক্ষ প্রবাসী। আমি ধারণা করি, ৩০০টি সংসদীয় আসনের ভোটারই আমিরাতে থাকে। তাহলে আমার ৩০০টা বুথ লাগবে। ৩০০টা আসন থেকে ব্যালট আনতে হবে। ৩০০ জন অফিসার আমাকে এখানে রাখতে হবে। কঠিন কাজ। এটা শুধু আরব আমিরাতের জন্য না, সব জায়গাতেই; যেখানে বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী সবখানে একই চিত্র।'
তবে ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া পরবর্তী যেকোনো নির্বাচনে প্রবাসীরা ভোট দিতে পারবেন বলে আশাবাদী আরব আমিরাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ তারেক আহমেদ। যদিও জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারার অপেক্ষার অবসান চান প্রবাসীরা।
“ভোট” শুধু একটি বাক্সে চিহ্ন দেওয়ার মাধ্যম নয়; এটি একটি নাগরিকের সম্মান, অধিকার ও অংশগ্রহণের প্রতীক। বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে দেশের বাইরে থাকা নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা অবশ্যম্ভাবী। প্রযুক্তি, আইন ও সদিচ্ছার সমন্বয় ঘটাতে পারলে প্রবাসীরাও দেশের ভবিষ্যত গঠনে সরাসরি অংশ নিতে পারবেন।
যারা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও ভোটাধিকার প্রয়োগে বঞ্চিত। এই সমস্যার সমাধানে প্রথমেই প্রয়োজন আইনি সংস্কার যেখানে প্রবাসীদের জন্য অনলাইন বা পোস্টাল ভোটের সুযোগ স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ থাকবে। নির্বাচন কমিশনকে একটি নির্ভরযোগ্য ই-ভোটিং বা পোস্টাল ভোটিং পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে, যা নিরাপদ, প্রযুক্তিনির্ভর এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য।
দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোতে ভোট কেন্দ্র স্থাপন কিংবা ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া দরকার। পাশাপাশি নির্বাচনী বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রবাসীদের মাঝে প্রচার চালাতে হবে।
প্রবাসীদের ভোটাধিকার শুধু নাগরিক অধিকার নয়, এটি একটি জাতীয় দায়িত্ব। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতেই হবে। এখনই সময় উপযুক্ত পরিকল্পনা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের এই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার।
লেখক: সভাপতি, প্রবাসী সাংবাদিক সমিতি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।
এমএ