তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির এই যুগে আমরা যেন এক অদৃশ্য বন্যায় ভেসে যাচ্ছি—এটি তথ্যের বন্যা। কিন্তু সেই বন্যা কেবল জ্ঞানের নহর নয়; এর মাঝে মিশে আছে বিভ্রান্তি, গুজব, এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যার প্রবল স্রোত। সত্যের পথ যতটা সরল, মিথ্যার পথ ততটাই চটকদার ও দ্রুতগামী। গবেষণায় দেখা গেছে, মিথ্যা খবর ছড়ায় সত্যের চেয়ে ছয়গুণ দ্রুত! এই ‘ক্লিকবেট’-নির্ভর সমাজে যেখানে তথ্যের অরণ্যে সত্যের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের অন্ধকার গলিতে আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি প্রতিনিয়ত। এ কারণেই বিভ্রান্তি ভাইরাল হচ্ছে আর সত্য দাঁড়িয়ে আছে একাকী, অলীক এক প্রান্তরে। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতিতে আজ আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে খবর পৌঁছায় মুহূর্তেই—ক্লিক, স্ক্রল, বা স্বয়ংক্রিয় নোটিফিকেশনের মাধ্যমে। কিন্তু এই যুগে সবচেয়ে বড় সংকট হল: বিভ্রান্তি বা ভুলতথ্য misinformation। সত্য-মিথ্যার বিভাজন ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিদিন এমন বহু কনটেন্ট ছড়ানো হচ্ছে, যেগুলো আংশিক সত্য, বিকৃত, কিংবা একেবারেই মিথ্যা।
একটি MIT গবেষণায় (Vosoughi et al., 2018) উঠে এসেছে, মিথ্যা খবর সত্যের চেয়ে ৬ গুণ দ্রুত ছড়ায়, এবং এটি মানুষের অনুভূতিকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে মানুষ সত্য জেনে উঠার আগেই ভুল বিশ্বাস গেঁথে যায়। এর ফলে বিকৃত তথ্য সমাজে বিভেদ, বিদ্বেষ, এমনকি সহিংসতাও উসকে দিতে পারে। ডিজিটাল যুগে তাই “তথ্য” শুধু সংবাদ নয়, এটি হয়ে উঠেছে একটি নৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত চ্যালেঞ্জ।
প্রযুক্তি যখন বিভ্রান্তির বাহক: এখনকার বিভ্রান্তিকর সংবাদগুলো অনেক বেশি চতুর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), Deepfake, Clickbait, AI-Generated Voice ও Automated Writing Tools ব্যবহার করে এমন সংবাদ তৈরি হচ্ছে যেগুলো সাধারণ পাঠক বা দর্শকের পক্ষে সহজে বোঝা অসম্ভব। বিশ্বের অনেক গণমাধ্যম, যেমন—BBC, India Today, The Guardian ইত্যাদি ইতিমধ্যে AI-ভিত্তিক misinformation detector চালু করেছে। BBC চালু করেছে BBC Verify, যা AI ও সাংবাদিকতার সম্মিলনে ফ্যাক্ট চেক করে প্রতিটি প্রতিবেদন। India Today-র AFWA (Anti Fake News War Room) প্রযুক্তিভিত্তিক এক বিশেষ ইউনিট যেটি প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া বিভ্রান্তি শনাক্ত করে। প্রশ্ন হচ্ছে—বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমে এরকম প্রযুক্তি ও দায়বদ্ধতা কতটা উপস্থিত?
ডিজিটাল বিভ্রান্তির মনস্তত্ত্ব: মানুষ কেন ভুল তথ্যে বিশ্বাস করে? সাইকোলজিক্যালি মানুষ তার পূর্বধারণা ও আবেগকে মিলে যায় এমন তথ্যেই বেশি বিশ্বাস করে। এ ধারণাকে বলা হয় confirmation bias। এ কারণে মানুষ মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য বারবার দেখলে সেটাকেই বাস্তব ধরে নেয়। একাধিক গবেষণায় বলা হয়েছে, এমনকি সত্য জানতে পারার পরও মানুষ মিথ্যাতে অনড় থাকে, যদি সেই মিথ্যা তার পরিচিত পরিবেশ ও মতবাদকে সমর্থন করে। ভয়ের ভিত্তিতে ছড়ানো সংবাদ যেমন—"বিদেশি ষড়যন্ত্র", "ধর্মীয় সংকট", কিংবা "জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে"—এ ধরনের কনটেন্ট দ্রুত ছড়ায় এবং বেশি মানুষ বিশ্বাস করে। কারণ এসব খবর মানুষের অচেতন ভয়ের সাথে খাপ খায়।
বিভ্রান্তির হাতিয়ার: সোশ্যাল মিডিয়ার অন্ধকার গলি: Facebook, TikTok, YouTube, WhatsApp—এই সব প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিন কোটি কোটি কনটেন্ট ছড়ায়। Pew Research-এর তথ্যমতে, ৭২% মানুষ ফেসবুক থেকেই সংবাদ পায়, যার মধ্যে প্রায় ৪০% তথ্য যাচাই না করেই বিশ্বাস করে। Meta (Facebook-এর মূল কোম্পানি) বলেছে—তাদের AI মডেল ২০২৩ সালে ৩০০ কোটি মিথ্যা পোস্ট শনাক্ত করেছে, কিন্তু সবগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কারণ: সব তথ্য ফ্যাক্ট-চেকার দ্বারা যাচাই করা সম্ভব নয়। অনেক পোস্টের ভাষা বা প্রেক্ষাপট আঞ্চলিক। কখনো কখনো রাজনীতি ও ধর্মীয় অনুভূতির কারণে কোম্পানিরাও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ভয় পায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: ফ্যাক্ট-চেকিং এখনো পেশাগত নয়। বাংলাদেশে কিছু উল্লেখযোগ্য Fact-Checking প্ল্যাটফর্ম আছে—যেমন: Rumor Scanner Bangladesh, BD FactCheck, FactWatch Rumor Scanner তাদের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তারা এক বছরে ১২৭৪টি বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট শনাক্ত করেছে, যার মধ্যে ৭৫% ছিল সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো। কিন্তু সমস্যা হল, মূলধারার পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলগুলোর নিজস্ব কোনো ফ্যাক্ট-চেকিং ডেস্ক নেই। যেটুকু কাজ হয়, সেটা সম্পূর্ণভাবে অলাভজনক স্বেচ্ছাশ্রম নির্ভর।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শফিকুর রহমান এক আলোচনায় বলেন, “প্রতিটি সংবাদমাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ fact-checking সেল থাকা উচিত। সম্পাদকরা যদি প্রতিযোগিতার চাপে সাংবাদিকদের বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছাপাতে উদ্বুদ্ধ করেন, তবে তাঁরা নিজেরাই এই পেশাকে দুর্বল করছেন। সেই অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।”
শিক্ষায় সংবাদ সচেতনতা: প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তরের প্রয়োজন।বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমে এখনো “News Literacy” বা “Media Literacy” নামে কোনো বিষয় নেই। অথচ UNESCO ও UNICEF বারবার বলছে, মাধ্যমিক পর্যায়েই তথ্য বিশ্লেষণের শিক্ষা দেওয়া জরুরি। ভারতের CBSE বোর্ড ২০২২ সাল থেকেই সহশিক্ষা হিসেবে “Media Literacy” চালু করেছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা শিখছে: খবরের উৎস যাচাই, ছবি ও ভিডিওর সত্যতা নির্ণয়, বিভ্রান্তিমূলক শিরোনাম চিহ্নিত, lateral reading এবং সউরচিং, বাংলাদেশেও এই ধরনের একটি পাঠ্যক্রম যুক্ত করা যেতে পারে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে, যেখানে “Critical Thinking”, “Fact vs. Opinion”, “Bias Detection” শেখানো হবে। তথ্যের যুগে শিক্ষিত মানে শুধুমাত্র ভালো নম্বর নয়, বরং তথ্যের মান বুঝতে পারা।
AI–এর সম্ভাবনা: প্রযুক্তিকে হাতিয়ার বানানো: AI এখন শুধু বিভ্রান্তি ছড়ায় না, বরং তা রোধ করতেও কার্যকর। অনেক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠান নিচের প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করছে: প্রযুক্তি, কাজ, AI Fact Check bot সন্দেহজনক পোস্ট শনাক্ত করে অ্যালার্ট দেয়, Reverse Image Search (AI-Powered) ছবি কোথা থেকে এসেছে তা খুঁজে বের করে Deepfake Detector, ভিডিও ও অডিওর সত্যতা যাচাই করে, Content Authenticity Initiative (CAI) ছবি ও তথ্যের কপিরাইট ও উৎস ট্র্যাক করে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোকেও এসব প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়, ICT Division ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যৌথভাবে এই প্রযুক্তি উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণে আগাতে হবে।
সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব: প্রতিযোগিতায় নয়, নীতিতে নেতৃত্ব: একটি ভুল সংবাদ যেমন জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ায়, তেমনই সাংবাদিকতার প্রতি আস্থা কমিয়ে দেয়। আজ প্রয়োজন—নৈতিক সাংবাদিকতা। কিছু প্রস্তাব: সংবাদমাধ্যমগুলোতে Fact-checking Desk বাধ্যতামূলক করা, প্রেস কাউন্সিলের AI-guided misinformation monitoring system গঠন, ফেসবুক, গুগল, টিকটকসহ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে স্বচ্ছতা ও রিপোর্টিং বাধ্যবাধকতাতে আনা, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাংবাদিকতা শিক্ষায় Misinformation & AI Literacy অন্তর্ভুক্তি।
পরিশেষ বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম: আমরা এক কঠিন সময় অতিক্রম করছি। যেখানে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ধূসর, সেখানে দায়িত্বশীল সংবাদ, শিক্ষিত পাঠক, আর প্রযুক্তি–তিনটি একত্রে না এলে বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে লড়াই অসম্ভব। শুধু AI চালু করলেই হবে না—প্রয়োজন তথ্যসংবেদী একটি সমাজ। আমাদের সাংবাদিকদের, শিক্ষাবিদদের, প্রযুক্তিবিদদের একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি সম্পাদক, সংবাদকর্মী, শিক্ষার্থী এবং পাঠকের—একই প্রশ্ন: তুমি বিভ্রান্তি রুখতে প্রস্তুত তো?
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রোজী মোজাম্মেল মহিলা অনার্স কলেজ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, দ্য ডেইলি অবজারভার