আমরা এখন এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে প্রযুক্তি শুধু আমাদের জীবনকে সহজ করে দিচ্ছে না, বরং তা আমাদের প্রতিদিনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। শিল্প, ব্যবসা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা যোগাযোগ—প্রযুক্তির উপস্থিতি সর্বত্র। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), রোবটিক্স, মেটাভার্স, স্মার্টফোন, ভিডিও কনফারেন্সিংসহ অসংখ্য আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রাকে করেছে গতিময়।
তবে প্রযুক্তির এই অভাবনীয় অগ্রগতির নেপথ্যে কিছু অন্ধকার দিকও রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শিশুদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব। বিশেষ করে স্মার্টফোন প্রযুক্তি এখন অনেক শিশুর জন্য আনন্দের চেয়ে অশান্তির উৎস হয়ে উঠেছে।
প্রযুক্তির সুবিধা ও ফাঁদ
অস্বীকার করা যাবে না—প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে বহু দিক দিয়ে উপকার দিচ্ছে। তবে প্রযুক্তির অতি ব্যবহার, বিশেষ করে স্মার্টফোনের মতো পোর্টেবল ডিভাইস, শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৮৬% প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত। এদের মধ্যে ২৯% শিশুর আসক্তি মারাত্মক পর্যায়ে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ৯২% শিশু তাদের বাবা-মায়ের ফোন ব্যবহার করে, এবং প্রতিদিন গড়ে তিন ঘণ্টা সময় ব্যয় করে, যা ইউনিসেফের সুপারিশকৃত সময়সীমার তিনগুণ।
কান্না থামাতে স্মার্টফোন, ফল উল্টো
এক বাবা-মা জানান, তাদের দুই বছর বয়সী সন্তান মাঝেমধ্যে অকারণে চিৎকার করে কাঁদত। কান্না থামাতে তারা শিশুর হাতে স্মার্টফোন তুলে দিতেন, যাতে সে কার্টুন দেখে শান্ত থাকে। শুরুতে কাজ করলেও পরে দেখা গেল, শিশুটি ফোন ছাড়া থাকতেই পারে না। ফোন না পেলে আরও জোরে কাঁদে, শরীরে নিজেই আঘাত করে। অভিভাবকরা এখন চরম উৎকণ্ঠায় ভুগছেন।
ভাষা বিকাশে বাধা
ঢাকার এক দম্পতির তিন বছর বয়সী কন্যা শিশুটি খুব কম কথা বলে। শুরুতে তারা বিষয়টি গুরুত্ব না দিলেও পরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসক জানান, শিশুটি ‘স্পিচ ডিলে’ সমস্যায় ভুগছে, যার একটি প্রধান কারণ অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, এখন তারা ধীরে ধীরে মোবাইল থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন।
মোবাইল কেনার জন্য ঢাকায় পালিয়ে আসা শিশু!
২০২৪ সালের একটি ঘটনায় দেখা যায়, ১০ বছরের এক শিশু ইউটিউবে একটি বিজ্ঞাপন দেখে ঢাকার একটি শপিং মলে মোবাইল কেনার কথা জানতে পারে। এরপর সে বাবার জমানো ৫০ হাজার টাকা নিয়ে গোপনে শেরপুর থেকে ঢাকায় চলে আসে, যাতে একটি স্মার্টফোন কিনতে পারে। শিশুটির মোবাইল আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সে বিপদ-আপদের চিন্তাও করে না।
কথা নয়, কেবল ভিডিও
২০২৫ সালের আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ধানমন্ডির একটি স্কুলের কেজি শ্রেণির এক শিশু প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না, বরং ভিডিও দেখতে থাকে। এক ভিডিও শেষ হওয়ার আগেই সে পরেরটিতে চলে যায়। জোর করে মোবাইল নিতে চাইলে চিৎকার করে বা কাঁদে। শিশুটি অধিকাংশ সময় স্মার্টফোনে ডুবে থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: অভিভাবকদের সচেতনতা জরুরি
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে শিশুরা বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছে না। অতিরিক্ত ব্যবহারে দেখা দিচ্ছে মাথাব্যথা, মাইগ্রেন, দৃষ্টিশক্তির ক্ষয়সহ নানা সমস্যা। অনেক শিশুকে অল্প বয়সেই চশমা পরতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা স্পষ্টভাবে বলছেন—শিশুর হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়ার আগে অভিভাবকদের ভাবতে হবে তারা সন্তানকে উপকার করছেন, নাকি ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
প্রযুক্তি যতই আধুনিক হোক না কেন, তার ব্যবহার সঠিকভাবে না হলে সেটিই হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদের কারণ। স্মার্টফোন শিশুদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই এখনই সময়—অভিভাবক ও সমাজকে সচেতন হয়ে শিশুদের রক্ষা করার।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক, সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক করতোয়া (ঢাকা অফিস)