একসময় সকালে চায়ের কাপ হাতে না তুললে যেমন ঘুম কাটতো না, তেমনি পত্রিকার পাতায় চোখ না বুলালে দিনটাই অসম্পূর্ণ থেকে যেত। পাড়ার মোড়ে দল বেঁধে মানুষ অপেক্ষা করত হকারের সাইকেলের ঘণ্টার শব্দ শোনার জন্য। “দেখি দেখি, আজকে আবার কী খবর!”—এই উত্তেজনা ছিল আমাদের নাগরিক চেতনার স্পন্দন।
অথচ আজ? চায়ের দোকান বা সেলুনে দু-একটি পত্রিকা পড়ে থাকে কেবল খদ্দের আটকানোর টুলস হিসেবে। কিছু অফিসে রাখা হয় শুধু ফরমালিটির খাতিরে। বাসাবাড়িতে খবরের কাগজ পড়ে কেবল কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, যারা এখনও স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছেন।
আমরা এখন তথ্যের বিস্ফোরণের যুগে বাস করছি, অথচ তথ্য জানার আগ্রহে নিঃস্ব এক প্রজন্ম হয়ে উঠেছি। স্ক্রল-আসক্ত চোখে এখন খবর মানে ক্যাপশন, বিশ্লেষণ মানে মন্তব্য, আর মতামতের ভিত্তি হয়ে উঠেছে পোস্টের থাম্বনেইল। পাঠের ধৈর্য, ভাবনার গভীরতা, প্রশ্ন করার সাহস—সবই যেন হারিয়ে ফেলেছি এক ‘ডিজিটাল অলসেমি’-এর মোহে।
খবর পড়া নয়, বরং দেখে ফেলা এখন বাস্তবতা। গণতন্ত্রের জন্য যে তথ্য-সচেতনতা অপরিহার্য, তা এখন পরিণত হয়েছে তথ্য-উপেক্ষায়। আমরা যেন এক ভেসে যাওয়া জাতি—যাদের চোখ আছে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি নেই; কান আছে, কিন্তু শ্রবণ নেই; প্রযুক্তি আছে, কিন্তু জিজ্ঞাসা নেই। যে সমাজে সত্য জানার আগ্রহ মরে যায়, সেখানে ভুলকে শাসক বানাতে সময় লাগে না। এই লেখা সেই শোকগাথা—এক নিঃশব্দ গণতান্ত্রিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি।
তথ্যের অভ্যুত্থান বনাম মনোযোগের পতন: বিংশ ও একবিংশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে তথ্যের যে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তাকে আমরা বলি ‘Information Boom’। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানুষের মনোযোগ (Attention Span) কমছে বিপরীত গতিতে। ২০০০ সালে যেখানে গড় মনোযোগের সময় ছিল ১২ সেকেন্ড, ২০২৩ সালে তা নেমে এসেছে মাত্র ৮ সেকেন্ডে—একটি সোনালি মাছের চেয়েও কম। (সূত্র: Microsoft Research)
একটি সমাজ যখন সংবাদের শিরোনাম দেখে পুরো ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে, ফেসবুকের মন্তব্য বক্সে নিজেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা ইতিহাসবিদ প্রমাণ করতে চায়, ইউটিউব ভিডিওর থাম্বেইল দেখেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়—তখন সেই সমাজ এক ‘post-truth’ বাস্তবতায় প্রবেশ করে। যেখানে আবেগ তথ্যকে ছাপিয়ে যায়, এবং মতামত হয়ে ওঠে বাস্তবের বিকল্প।
বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে তথ্যবিমুখতা: CPD ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB)-এর ২০২৪ সালের এক জরিপে দেখা যায়—৬২% মানুষ কোনো নিউজ লিংক খুলে দেখে না; ক্যাপশন দেখে মন্তব্য করে। ৪৮% মানুষ জানেই না তারা যে খবর শেয়ার করছে, সেটির উৎস কী কিংবা সেটি সত্য না মিথ্যা।
বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (PIB)-এর ২০২৩ সালের সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে ১৫–৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ৭৩% সংবাদ গ্রহণ করে শুধুই সামাজিক মাধ্যমে; যার মধ্যে ৫৮% ‘শিরোনাম নির্ভর’ পাঠক।
এটি কি কেবল একধরনের তথ্য-আলসেমি? নাকি এটি একটি সুপরিকল্পিত সামাজিক বিপর্যয়ের লক্ষণ?
এ বিষয়ে বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি: ড. আলতাফ পারভেজ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “শিরোনাম দেখে মত দেওয়ার প্রবণতা আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা ধ্বংস করছে। তরুণ প্রজন্ম এখন আর প্রশ্ন করে না—তারা রায় দেয়।”
ড. রুবায়েত ফেরদৌস, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাবি: “এই হেডলাইন কালচার এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক অলসতা। এর পেছনে সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগরিদমের বড় ভূমিকা রয়েছে—যা কেবল পছন্দের কনটেন্টই দেখায়।”
জার্মান মিডিয়া গবেষক নীল পোস্টম্যান বলেছিলেন, “We are amusing ourselves to death.”—আজ তা যেন সত্যি। আমরা নিজেদের ধ্বংস করছি ‘তথ্যভোগ’-এর নামে, কিন্তু বিশ্লেষণহীনভাবে।
প্রযুক্তির অ্যালগরিদমিক ফাঁদ: ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক—সব প্ল্যাটফর্মই একধরনের অ্যালগরিদম ব্যবহার করে যা কেবল ব্যবহারকারীর পছন্দ ও প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে কনটেন্ট দেখায়। এর ফলে তৈরি হয় Echo Chamber—যেখানে আপনি নিজের মতের বাইরের কিছু দেখেন না। এর প্রভাবে চিন্তা হয় একপেশে, সহনশীলতা কমে যায়, জন্ম নেয় ‘মতামতের অহংকার’। ফলে ব্যক্তি বিভ্রান্ত হয়, আর সমাজ হয় মেরুকৃত। রাজনীতি, ধর্ম, ইতিহাস—সব কিছুতেই বিভাজন বাড়ে।
মিডিয়া ও তথ্যবাজার: সংবাদ নয়, শোরগোল: বর্তমান মিডিয়া অনেক ক্ষেত্রেই সংবাদ নয়, ভাইরাল কনটেন্টের বাজার হিসেবে কাজ করছে। যে খবর বেশি ক্লিক পাবে, সেটিই গুরুত্ব পায়। তাই গঠনমূলক নীতিনির্ধারনী খবর চাপা পড়ে যায়, অথচ তুচ্ছ কেলেঙ্কারি প্রথম পাতায় আসে।
রবি শর্মা, ভারতীয় সাংবাদিক বলেন, “পাঠক এখন আর নাগরিক নয়, তারা কনজিউমার। তারা তথ্য নয়, বিনোদন খোঁজে।”
নাগরিক দায়িত্ব ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ: গণতন্ত্র কেবল ভোটাধিকার নয়—তথ্যজ্ঞান ও সচেতন মত গঠনের ওপরই এর ভিত্তি দাঁড়িয়ে। কিন্তু যখন নাগরিকরা তথ্য চায় না, কেবল প্রতিক্রিয়া দিতে চায়, তখন—গুজব বাড়ে, মতামত বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে, আর নির্বাচন, নীতিনির্ধারণ, সামাজিক আন্দোলন—সব ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়।
নোবেলজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসা বলেন, “A lie told a million times becomes the truth—if people don’t bother to read beyond the headline.”
ভবিষ্যতের সংকেত: ছোটবেলায় পড়েছিলাম—একদিন মানুষ নিজে ভাত খাবে না, সুইচ টিপলেই মুখে চলে যাবে খাবার। তারপর বলবে, “চিবিয়ে দাও,” তারপর “গিলে দাও,” তারপর “হজমও করে দাও।” এখন সেটিই বাস্তব হতে চলেছে চিন্তা, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও।
যদি এই প্রবণতা বন্ধ না হয়, তাহলে: Deepfake ভিডিও আমাদের বাস্তবতা নিয়ন্ত্রণ করবে। AI দ্বারা তৈরি বিভ্রান্তিকর শিরোনাম পাঠককে আরও বেশি ভ্রমিত করবে। সত্য হারিয়ে যাবে, যাচাই করার আগ্রহ বিলুপ্ত হবে।
হার্ভার্ড মিডিয়া গবেষক কেসি ওয়াই বলেন, “A society that stops reading stops thinking. And a society that stops thinking becomes programmable.”
করণীয় ও প্রস্তাবনা; মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ‘মিডিয়া লিটারেসি’ কোর্স চালু, বিশ্ববিদ্যালয়ে “ডিজিটাল সিটিজেনশিপ” ও “তথ্য বিশ্লেষণ” অন্তর্ভুক্ত সরকারি উদ্যোগ: জাতীয় গণমাধ্যম শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, ডিজিটাল মিডিয়া মান নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা প্রণয়ন।
মিডিয়ার ভূমিকা: সংবাদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ দেওয়া, যাচাইকৃত সংবাদ প্রচারে অগ্রাধিকার।
নাগরিক সচেতনতা: Fact-checking প্ল্যাটফর্ম (যেমন: BoomBD, Factwatch) ব্যবহার, মতামত দেওয়ার আগে সম্পূর্ণ খবর পড়ার অভ্যাস গঠন। শুধু ক্যাপশন দেখেই মত গঠন করা, শিরোনাম দেখে রায় দেওয়া—এগুলো কেবল প্রযুক্তিগত অলসতা নয়, বরং এক সামাজিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস। একটি জাতি যদি নিজেদের চিন্তা, বিচার, বোধ—‘ভিজ্যুয়াল ইম্প্রেশন’ বা ডিজিটাল ক্যাপশনের হাতে বন্দি করে ফেলে, তবে সে জাতি ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে না—বরং কেবল ভোগ করে অন্যদের বানানো ইতিহাস।
আমাদের দরকার একটি সচেতন পাঠক সমাজ—যারা পড়বে, ভাববে, প্রশ্ন করবে। না হলে ভবিষ্যতের ইতিহাস লিখে রাখবে:“একটি ক্যাপশনপ্রেমী জাতি নিজেদের স্বাধীন চিন্তাশক্তি নিজের হাতেই ধ্বংস করেছিল।”
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রোজী মোজাম্মেল মহিলা অনার্স কলেজ। কলামিস্ট, দ্য ডেইলি অবজারভার