গাছ থেকে ঝরে পড়া সুপারির খোল দিয়ে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব বাটি, প্লেট ও ট্রেসহ ১০ ধরনের তৈজসপত্র। এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে হোটেল-রেস্টুরেন্ট এবং সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাবার পরিবেশনের জন্য।
পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার নারী উদ্যোক্তা নিলুফার ইয়াসমিন গড়ে তুলেছেন এসব ওয়ান টাইম তৈজসপত্র তৈরির একটি কারখানা।
কাউখালী-ঝালকাঠি সংক্ষিপ্ত সড়কের পাশে উপজেলার লাঙ্গুলী গ্রাম এখন গ্রামীণ অর্থনীতির একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। এখানে সুপারির খোল দিয়ে নানান ধরনের তৈজসপত্র তৈরি করছেন উদ্যোক্তা নিলুফার ইয়াসমিন।
তিনি জানান, উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সুপারি গাছের খোল সংগ্রহ করে সেগুলো পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে রোদে শুকানো হয়। এরপর সেগুলো ছাঁচের মেশিনে বসিয়ে গোলাকার বাটি, প্লেট, চৌকোণা প্লেট ও ট্রেসহ মোট ১০ ধরনের তৈজসপত্র তৈরি করা হয়।
এ বিষয়ে নিলুফার ইয়াসমিনের স্বামী ইঞ্জিনিয়ার জুয়েল জানান, তার স্ত্রী বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানতে পারেন যে প্লাস্টিকের সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। তখন থেকেই তিনি ভাবতে থাকেন—প্লাস্টিকের বিকল্প কী হতে পারে।
পরে ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে জানতে পারেন, সুপারি গাছের খোল দিয়ে পরিবেশবান্ধব সামগ্রী তৈরি করা সম্ভব। তখন তিনি এই বিষয়টি স্বামীকে জানান এবং এ ধরনের একটি উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি আরও জানান, স্ত্রীর আগ্রহে তিনি কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু মেশিন আমদানির বিষয়টি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভারত বা অন্য কোনো দেশ থেকে মেশিন আনতে গেলে খরচ অনেক বেশি পড়ছিল। তখন তিনি অন্য একটি কারখানা দেখে ইন্ডিয়ান মেশিনের আদলে নিজের পরিকল্পনায় দেশেই একটি মেশিন তৈরি করে ফেলেন।
পরে কাউখালী-ঝালকাঠি সংক্ষিপ্ত সড়কের পাশে লাঙ্গুলী সাহাপুরা গ্রামে মামা ফরিদ হোসেনের একটি ঘর ও জায়গা ১০ বছরের চুক্তিতে ভাড়া নিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘ন্যাচারাল বিউটি’ নামের এই কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
এ কারখানায় এখন তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার থালা, বাটি, পেয়ালা, ট্রে ও অন্যান্য পরিবেশবান্ধব সামগ্রী। উদ্যোক্তার ভাষায়, উন্নত মানের একটি বড় খোল দুই টাকায় কেনা হয়। বর্তমানে ৪ জন কর্মচারী সম্পূর্ণ কেমিক্যালমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে দৈনিক ৫০০–৬০০টি তৈজসপত্র তৈরি করছেন।
বর্তমানে কারখানার বিদ্যুৎ বিল ও কর্মচারীদের বেতন বাবদ মাসে প্রায় ৫০–৬০ হাজার টাকা ব্যয় হলেও, তার স্ত্রী লাভবান হচ্ছেন বলে জানান জুয়েল।
সুবিদপুর গ্রামের সুপারি বাগানের মালিক মনিরুজ্জামান বলেন, "আগে সুপারি গাছের খোলগুলো বাড়ির আশেপাশে পড়ে থাকত। এসবের সর্বোচ্চ ব্যবহার ছিল আঙিনার বেড়া হিসেবে। মাঝে মাঝে রান্নাবান্নায় জ্বালানির কাজেও ব্যবহার করা হতো। এখন এসব খোল কারখানার মালিকরা কিনে নিচ্ছেন, এতে আমরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছি।"
কারখানায় কর্মরত তৌহিদ বলেন, "বাড়ির পাশে এই কারখানা হওয়ায় আমি এখানে কাজ করি। ভালোই চলতে পারি। এখানে অনেকেই কাজ করছে।"
আরেকজন কর্মী বলেন, "এখানে কাজ করে আমরা অনেকেই সংসার চালাচ্ছি।"
এ কারখানায় প্রতিদিন ৫০০–৬০০টি প্লেট ও বাটি তৈরি হয়, যা রাজধানীর অভিজাত এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠান, রেস্টুরেন্ট ও দোকানে সরবরাহ করা হয়।
তবে উদ্যোক্তাদের বিশ্বাস, প্রয়োজনীয় প্রচার না থাকার কারণে এই পণ্যের তেমন প্রসার ঘটেনি। ভালোভাবে প্রচার পেলে দেশে এবং বিদেশে পরিবেশবান্ধব এই পণ্যের বাজার সৃষ্টি হবে বলে তারা আশাবাদী।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) জেলা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপ-ব্যবস্থাপক এইচ.এম. ফায়জুর রহমান বলেন, "উপকূলীয় জেলা হিসেবে পিরোজপুরের কাউখালীতে প্রচুর সুপারি গাছ রয়েছে। এই গাছের খোল দিয়ে যেসব পরিবেশবান্ধব ওয়ান টাইম পণ্য তৈরি হচ্ছে, তা অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। এই বিষয়ে বিসিক প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহযোগিতার মাধ্যমে পাশে থাকতে আগ্রহী।"
আরএইচ/আরএন