একটি জাতির পরিচয় নির্ধারিত হয় তার মূল্যবোধ, রাষ্ট্রের নৈতিকতা এবং নাগরিকদের স্বাস্থ্যচেতনার ওপর ভিত্তি করে। সেই বাংলাদেশ, যেখানে স্বাধীনতার পর স্বপ্ন ছিল আত্মনির্ভরতার, সেখানে আজ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এক নীরব ঘাতক—নকল সিগারেট। চায়ের কাপের ধোঁয়ার আড়ালে যে ধোঁয়া উঠছে শহর থেকে গ্রামে, তা আর নিছক অভ্যাস নয়; তা এক বিষাক্ত প্রতারণার প্রতিচ্ছবি। আমরা আজ এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে মানুষ শুধু ঠকছে না, বরং প্রতিদিন বিষ টেনে নিজের শরীর, মন এবং রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে চলেছে।
নকল সিগারেট: অভ্যাসের আড়ালে মৃত্যুর থাবা
সিগারেট একসময় ছিল কিছু মানুষের ফ্যাশন, কিছু মানুষের ক্লান্তির পরম সঙ্গী। কিন্তু আজ? নামী ব্র্যান্ডের মোড়কে মোড়ানো নকল সিগারেট ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রান্তে প্রান্তে। গুরুদাসপুরের এক দোকানে বসে থাকা দিনমজুরের হতাশার সুর যেন সারাদেশের কান্না: “এইটা সিগারেট না ভাই, আগুন ধরালেই হাওয়া… দুই টানেই খতম।” এই “খতম” কেবল সিগারেটের নয়, খতম হচ্ছে তার জীবনীশক্তি, ধ্বংস হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ। গবেষণা বলছে, নকল সিগারেটে তামাকের বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক, বালি, পোড়া কাপড়ের গুঁড়ো, এমনকি বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান। এই উপাদানগুলো সরাসরি ফুসফুস, যকৃত ও কিডনির মারাত্মক ক্ষতি করে।
স্বাস্থ্য নয়, করের দোহাই: রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার এক প্রতিচ্ছবি
নকল সিগারেট কেবল এক ব্যবসায়িক প্রতারণা নয়, বরং এটি একটি রাষ্ট্রীয় লজ্জা। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অথচ আইন আছে, প্রশাসন আছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে—তবু যেন কার্যকর কোনো প্রতিরোধ নেই। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (BSTI) কেবল মোড়কের গায়ে সতর্কতামূলক ছবি ছাপিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলছে। অথচ এই ছবির ভেতরের সিগারেটেই লুকিয়ে আছে মৃত্যু।
সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়
নকল সিগারেট কেবল একজনের শরীরের ক্ষতি করছে না; এটি সমাজের মানসিক কাঠামোকেও গ্রাস করছে। সহজলভ্যতার কারণে কিশোরেরা অল্প বয়সেই এই বিষাক্ত আসক্তির ফাঁদে পড়ছে। মধ্যবয়সী এক ব্যক্তির কথায় যেন ফুটে উঠেছে এই দুঃখগাঁথা: “এখনকার সব কিছুই এমন—ধোঁয়া ছাড়ে না, শুধু নিঃশব্দে পুড়ে যায়। যেমন আমার জীবনটা!”
এই নিঃশব্দ জ্বলে যাওয়া আমাদের জাতীয় ট্র্যাজেডি। একদিকে যুবসমাজ হারাচ্ছে কর্মক্ষমতা, অন্যদিকে আমরা হারাচ্ছি জাতির মেরুদণ্ড।
অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ আলী বলছেন: “নকল সিগারেট শুধু জনস্বাস্থ্য নয়, সরকারের রাজস্ব কাঠামোকেও ধ্বংস করছে। কর ফাঁকি দিয়ে এই অবৈধ ব্যবসা রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে নিঃশেষ করছে।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, তামাকজাত পণ্যজনিত কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মারা যায়। এই মৃত্যুর একটি বড় অংশ এখন নকল পণ্যের কবলে। সরকার প্রতি বছর তামাকজাত পণ্য থেকে গড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও নকলের দৌরাত্ম্যে তা থেকে ৭-৮ হাজার কোটি টাকা হাতছাড়া হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা: নকলবিরোধী কার্যকর কৌশল
মেক্সিকো: নকল সিগারেট উৎপাদকদের বিরুদ্ধে প্রযুক্তিনির্ভর ‘Track & Trace’ সিস্টেম চালু করে সফল হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন: আইন অনুযায়ী প্রতিটি সিগারেট কার্টনের উৎস ও করের হিসাব রেজিস্ট্রারে সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক।
ফিলিপিন্স: জাতীয়ভাবে স্ট্যাম্পিং ব্যবস্থা চালু করে নকল উৎপাদকদের আইনি কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে।
বাংলাদেশেও এই উদাহরণগুলো অনুসরণ করে যথাযথ প্রযুক্তিনির্ভর ও কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।
সমাধানের পথ: শুধু আইন নয়, চাই বিবেকের জাগরণ
১. ‘Track & Trace’ পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করা
২. জোরালো আইন প্রয়োগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি
৩. জনসচেতনতামূলক গণমাধ্যম ক্যাম্পেইন
৪. ছাত্র ও কিশোরদের মাঝে সচেতনতা ছড়ানো
৫. বাজার মনিটরিং ও কাস্টমস বিভাগের দক্ষতা বৃদ্ধি
সরকারের উচিত এই বিষয়ে ‘জাতীয় সিগারেট নিয়ন্ত্রণ কমিটি’ গঠন করা, যেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং নাগরিক সমাজ একযোগে কাজ করবে। এই দেশ আমাদের। এই সমাজ, এই ভবিষ্যৎ আমাদের সন্তানদের। আমরা কি এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে প্রতিটি চায়ের দোকান বিষের হাটে পরিণত হবে? যেখানে একটি টানেই নিঃশেষ হয়ে যাবে এক জীবন, এক সম্ভাবনা?
নকল সিগারেটের বিরুদ্ধে সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নিলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায় শূন্য থেকে যাবে। তাই এখনই সময়—উঠে দাঁড়ানোর, সোচ্চার হওয়ার। আমরা চাই না ধোঁয়ার আড়ালে আমাদের জাতীয় সত্তা নিঃশেষ হয়ে যাক।
“টান দিচ্ছি সিগারেটে, নিঃশেষ হচ্ছি প্রতিদিন একটু একটু করে…”—এই কবিতা আর নয়, এবার হোক প্রতিরোধের অগ্নিশপথ।
আরএন