রাজশাহীতে লাগামহীন হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের নেতা ও নেত্রীদের তৈরি করা কিশোর গ্যাং’। দলীয় পরিচয়ের বাইরে থেকে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ইভটিজিং, চুরি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজিসহ গ্যাংয়ের নানা অপরাধযজ্ঞে অতিষ্ঠ রাজশাহীর জনসাধারণ। ঘটছে হত্যার মতো ঘটনাও। আসামির তথ্য দিলেও পুলিশের নীরব ভূমিকার অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজশাহী মহানগরীতে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি মূলত বড় দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও তৎকালীন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের মধ্যে এ বিরোধ ছিল। আর লিটনের মেয়ে আনিকা ফারিহা জামান অর্না ছিলেন আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপ-কমিটি, রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ এবং যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যান লিটন। বর্তমানে তারা ভারতে রয়েছেন। আর বড় মেয়ে অর্না তার স্বামীকে নিয়ে পালান থাইল্যান্ডে। ডাবলু সরকার রাজশাহীর পাশের জেলা নওগাঁয় আত্মগোপনে যান। তবে র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে রাজশাহী কারাগারে রয়েছেন তিনি।
সূত্র বলছে, মহানগরীতে এ তিন নেতা গড়ে তোলেন কিশোর গ্যাং। সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডে আলাদা আলাদা বাহিনী তৈরি হয় তাদের। গ্যাংয়ের সদস্যদের কাছে সরবরাহ করা হতো মাদক ও অস্ত্র। আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত রাসিক কাউন্সিলরদের পৃষ্ঠপোষকতায় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে তারা জড়াত হত্যাসহ নানা অপরাধে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হলে কয়েক বছর আগে কিশোর গ্যাং ধরতে ডাটাবেজ করে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি)। সেই ডাটাবেজ অনুযায়ী সন্দেহভাজন কিশোরদের আটক করা হয়। পরে মুচলেকা নিয়ে পুলিশ তাদের অভিভাবকের জিম্মায় দেয়। এছাড়া সিসিটিভি দিয়ে মহানগরীর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অপরাধী শনাক্ত ও আটক করছিল পুলিশ। তবে ক্ষমতাসীন নেতাদের চাপে কিশোর গ্যাং ইস্যু ধামাচাপা পড়ে যায়।
তথ্যমতে, গত বছরের জুলাই মাসে মহানগরীর বনগ্রাম গাংপাড়া এলাকায় হাঁসুয়া, চাপাতি, রামদা, চাইনিজ কুড়াল, চাকু ও ছুরিসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে নাচানাচি করে কিশোর গ্যাংয়ের একটি গ্রুপ। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ড্রামের বাজনার সঙ্গে সঙ্গে বুনো উল্লাস করছিল তারা। এ নিয়ে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে অবশ্য পুলিশ কয়েকজনকে আটক ও বেশকিছু অস্ত্র উদ্ধার করে।
সূত্রমতে, বর্তমানে মহানগরীর ভদ্রা মোড়, সিএন্ডবি, লক্ষিপুর, টিকাপাড়া (খুলিপাড়া), কেদুর মোড়, হোসনিগঞ্জ বেতপট্টি, পাঠানপাড়া, কলাবাগান, অলোকার মোড়, হেতম খা, নিউ মার্কেট, তালাইমারি, বিমান বন্দর সড়ক, গ্রেটার রোড ও সিটি বাইপাসসহ আরও অন্তত ১৫টি পয়েন্টে কিশোর গ্যাং সদস্যরা প্রকাশ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পথচারী ও অটোরিকশাযাত্রীদের থেকে ছিনিয়ে নেন টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র।
মহানগরীর বাসিন্দাদের অভিযোগ, এলাকাভিত্তিক গড়ে ওঠা বিভিন্ন কিশোর গ্যাং আবারও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশের নজরদারির অভাবে নতুন নতুন গ্রুপও তৈরি হচ্ছে। ছিনতাই ও ছুরিকাঘাত যেন নিত্যদিনের ঘটনা। মোটরসাইকেল নিয়ে হচ্ছে বেশিরভাগ ছিনতাই।
ড্রাইভার সজল উদ্দিন একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আছেন। গত বছরের ১৯ অক্টোবর বিকেলে তার স্ত্রীর কাছ থেকে স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল ও টাকা ছিনতাই করা হয়। পরে তারা থানায় অভিযোগ দেন।
জানতে চাইলে সজল বলেন, আমার স্ত্রী ও ছোটবোন দুই সন্তানকে নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট থেকে দাওয়াত খেয়ে আসছিলেন। রাজশাহী রেলগেটে বাস থেকে নামার পর রিকশায় ওঠেন। গয়না ও মোবাইল পার্টস ব্যাগে রেখেছিলেন। ভদ্রার অদূরে রেশম অফিসের বিপরীত দিকে ভাঙড়িপট্টির সামনে মোটরসাইকেলে করে দুজন এসে ব্যাগটি ছিনতাই করে নিয়ে যায়। সজলের অভিযোগ, মোবাইল উদ্ধার হওয়ার পর আসামিকে আমি চিহ্নিত করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আলী আকবরকে জানাই। তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে আসামি ধরছেন না, আমার ছিনতাই হওয়া জিনিসও উদ্ধার করছে না।
এসআই আলী আকবর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের অলিখিত ‘বডিগার্গ’ হিসেবে কাজ করেছেন। বিষয়টি আরএমপি কমিশনার জানার পর তাতে বদলির আদেশ দেন। এছাড়া ডিবির এএসআই রানা কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে অপরাধে জড়িত। পুলিশের পোশাকে অপরাধীদের সঙ্গে সখ্যতা করে অনেক অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও সূত্রটি জানিয়েছে।
গত বছরের ২৭ নভেম্বর একই জায়গায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন ট্রান্সপরেন্সি ইন্টারন্যাশন্যাল বাংলাদেশের সদস্য প্রকৌশলী রাবেয়া বারি। তাৎক্ষণিকভাবে বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন তিনি। রাবেয়া বারি বলেন, ভাঙড়িপট্টির সামনে মোটরইসাইকেলে করে এসে আমার ব্যাগ ছিনতাই করে দুজন ব্যক্তি। ব্যাগে দুটি এন্ড্রয়েড মোবাইল, ব্যাংকের ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড, টাকা ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছিল। পরে থানায় অভিযোগ করতে গেলে একটি ফোন কলে জানানো হয়, ব্যাগটি একটি জায়গায় পড়ে আছে। সেখানে গিয়ে ব্যাগ পাই। কিন্তু ফোন, টাকাপয়সা আর পাইনি।
তার স্বামী আরিফুর রহমান বলেন, একই জায়গায় দুজন কোরিয়ান নাগরিকের মোবাইল ও ল্যাপটপ ছিনতাই করা হয়েছে। রাবেয়া বারি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এসব ঘটনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
নভেম্বরেই মহানগরীর ভদ্রা এলাকায় মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বজলুর রহমান মন্টুকে ছুরিকাঘাত করা হয়। তার পেটে ও কপালে ছুরিকাঘাত করা হলে তিনি গুরুতর জখম হন। পরে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন মন্টু।
এদিকে, মহানগরীতে হত্যার ঘটনাও কম নয়। গত বছরের ২৬ অক্টোবর রাত ১০টায় মহানগরীর পঞ্চবটি এলাকায় মিম (২০) নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর এয়ারপোর্ট থানার ভুগরইলে অটোচালক সিরাজুল ইসলাম, ২২ সেপ্টেম্বর দামকুড়া থানায় অটোচালক সাজামুল ইসলাম, ১৭ অক্টোবর কাঁটখালীতে রিকশাচালক আলম নামের তিন ব্যক্তির হত্যার শিকার হন। এছাড়া ২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট সন্ধ্যায় কচুয়াতৈল এলাকায় পল্লী চিকিৎসক এরশাদ হত্যা এবং একই রাতে বর্ণালী এলাকায় ডা. কাজেম আলীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। ডা. কাজেম খুনের ঘটনায় পুলিশের উচ্চপদস্থ দুই কর্মকর্তা সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ করেছেন চিকিৎসকরা।
সংবাদ সম্মেলনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের হেমাটলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এম মুর্শেদ জামান মিঞা বলেন, আরএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বিজয় বসাক ও সাইবার ক্রাইম ইউনিটের প্রধান উৎপল কুমারকে ধরলেই হত্যার সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া থাকায় আইনের আওতায় আসেন না তারা। পুলিশের সম্পৃক্ততারও অভিযোগ উঠেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডিআইজি জানান, পুলিশের স্বভাব পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত অপরাধ কমবে না। মহানগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে থানার ওসিদের সখ্যতা রয়েছে। তারা সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়।
মহানগরীতে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন সচেতন মহল। এ বিষয়ে সুশানের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহীর সভাপতি আহমেদ শফি উদ্দিন বলেন, এসব ঘটনা আমরা কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্য করেছি। এগুলো রীতিমতো আশঙ্কাজনক ও আতঙ্কজনক। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজ- কারোই তেমন ভূমিকা দেখিনি। কিশোরদের নির্মল বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের সময় কাটানোর ব্যবস্থা, ক্রীড়া ও জ্ঞান চর্চাসহ কাজে লাগাতে হবে। পাড়া-মহল্লায় মাঠ থাকবে। শুধু গালিগালাজ করে আইন দিয়ে হবে না, তাদের ভালবাসতে হবে। আর যারা একেবারে বিপথে চলে গেছে, তাদের চিকিৎসা করাতে হবে।
এসব বিষয়ে আরএমপির বোয়ালিয়া জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) অনির্বান চাকমা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, আমাদের এডিসি মিডিয়া একজন আছেন, আপনি তার সঙ্গে কথা বলেন।
আরএমপির মুখপাত্র সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, আমরা কাজ শুরু করেছি। ৫ আগস্ট আমাদের আরএমপির হেডকোয়ার্টারে অগ্নিসংযোগের ফলে ডাটাবেজ নষ্ট হয়ে গেছে। সেজন্য আমরা পুরনো তালিকা নিয়ে কাজ করতে পারছি না। তবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এসআর