পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) খামখেয়ালীতে মুমূর্ষু অবস্থায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বরইতলা নদী। অপরিকল্পিত বাঁধ র্নিমাণের ফলে এখন দিন দিন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে একসময়ের খরস্রোতা এ নদীটি।
চির যৌবনা এ নদীটির এমন করুন হাল দেখে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নদীপাড়ের বাসিন্দা, সাধারণ কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। নদীর স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন জেলা নদী বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দসহ পরিবেশবাদীরা।
কলাপাড়া উপজেলার ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের গাববাড়িয়া পয়েন্টে জীবন্ত এ নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয় কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, কলাপাড়া উপজেলার ডালবুগঞ্জ ও মহিপুর সদর ইউনিয়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীটি কাগজে-কলমে বরইতলা নদী নামে পরিচিত। তবে স্থানীয়রা একে ‘সোনামুখী’, আবার কেউ ‘গাববাড়িয়া নদী’ নামেও চেনে। একসময়ের খরস্রোতা এ নদীর গাববাড়িয়া পয়েন্টে হঠাৎ করে পানি উন্নয় বোর্ড একটি অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ বাঁধ নির্মাণের ফলে জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাবে বরইতলাসহ এটার সাথে সংযুক্ত তিন দিকের শাখা নদীগুলো প্রায় মৃত হয়ে পড়ে।
সরেজমিনে পরির্দশনকালে দেখা যায়, শীত মৌসুম শুরুর আগেই শাখা খালগুলোতে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এখন আর নদীর অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। বেড়িবাঁধের ভেতরের পানি নিষ্কাশনের জন্য থাকা ১৯টি স্লুইসগেট অকেজো হয়ে পড়েছে। জোয়ারের সময় পানি উঠলেও ভাটায় পানি নামানো যাচ্ছে না। পানি নামতে না পারার ফলে ডালবুগঞ্জ, ধুলাসার, মিঠাগঞ্জ, মহিপুর ও বালিয়াতলী ইউনিয়নের অন্তত ৪০টি গ্রাম বর্ষা মৌসুমে স্থায়ী ভাবে জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এতে প্রায় ৭৫ হাজার একর জমির চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একই সাথে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন এসব এলাকার অর্ধ লক্ষাধিক কৃষক।
জীবনের অধিকাংশ সময় কৃষি কাজ আর নদীতে মাছ ধরে পার করেছেন স্থানীয় প্রবীন বাসিন্দা আবদুল খালেক (৭৬)। ডেইলি অবজারভারকে তিনি বলেন, 'একসময় এই নদীপথ দিয়ে নৌকা, লঞ্চ, ট্রলার চলাচল করত। ভাসানি ব্যবসায়ীরা বড় বড় নৌকায় মালামাল নিয়ে গঞ্জের হাটে যেতেন। বরইতলা নদী এত স্রোতস্বনী ছিলো যে সাঁতার দিয়ে সোজাসুজি ওপাড়ে পৌঁছানো যেত না। স্রোতের টানে অন্তত আধা মাইল নামিয়ে নিয়ে যেত। একসময় এ নদীতে প্রচুর মাছ ধরা পড়তো। ইলিশ থেকে শুরু করে এমন কোনো মাছ নাই যা পাওয়া যেত না। বিশেষ করে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে গলদা চিংড়ি মাছ পাওয়া যেত কেজিতে কেজিতে। এখন এগুলো সবই স্মৃতি।
আবদুল খালেক বলেন, 'বাঁধ দেয়ার আরও কয়েক বছর আগেই নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন এখন সড়ক নির্ভর। তবে বাঁধ দেয়ার ফলে মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের জীবিকা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। এছাড়া নদী তীরের জনপদের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় কৃষক মো. সলেমান হাওলাদার (৫৫) ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'আগে খাল-বিলের পানি ব্যবহার করে সহজেই জমিতে সেচ দেওয়া যেত। কিন্তু এখন খালে পানি না থাকায় অত্যন্ত ব্যয়বহুল যান্ত্রিক সেচের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে কৃষি উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেছে বহুগুন। একইসঙ্গে বেড়েছে উৎপাদিত ফসলের বাজার মূল্য।'
মালেক খা (৬২) ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'স্লুইস গেটগুলো দিয়ে ভাটার সময় পানি নামতে পারে না। এ কারণে বর্ষার শুরুতেই হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে তলিয়ে যায় আমন ক্ষেত।'
আকবর প্যাদা (৪৫) বলেন, 'স্থায়ী জলাবদ্ধতায় কৃষকরা বীজতলা পর্যন্ত করতে পারেন না। এমনকি গবাদিপশু পালনেও চরম বিপাকে পড়েছেন।
মনসাতলী গ্রামের স্থানীয় আরেক কৃষক সিদ্দিক হাওলাদার (৫২) ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'বাঁধ নির্মাণের ফলে বরইতলা-সোনাতলা সংযোগ নদীর চারটি শাখা নদীর পানি প্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ভাটার সময় সাপুড়িয়া হয়ে পানি নামতে নামতে আবার জোয়ার এসে যায়। প্রায় সব স্লুইসগেটই পলি জমে মাটির নিচে দেবে গেছে। পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে কাঁটাভাড়ানি খাল ও বরইতলা নদী পলি পড়ে দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদী দ্রুত ভরাট হয়ে যাওয়ায় পলি পড়ার কারণে নদী তীরের সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ বনভূমিও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। শ্বাসমূলে পলি পড়ার কারনে ধীরে ধীরে গাছ মরে যাচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'বরইতলা নদীতে বাঁধ দেওয়ার কারণে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাবলাতলা স্লুইস খালের ওক্কাচোরা পয়েন্টে খালের মধ্যে বাঁধ দিয়ে ছোট ছোট পুকুর বানানো হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা এখন সেখানে মাছের চাষ করেন।'
স্থানীয় মিরপুর গ্রামের কৃষক আলতাফ হোসেন (৪৫) ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'বরইতলা নদী নেই, প্রায়ই মরে গেছে। এখন এপার থেকে ওপারে হেঁটে যাওয়া যায়। অথচ একসময়ের খরস্রোতা এ নদীতে জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
তিনি বলেন, 'যেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ দিয়েছে সেখানে একটি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করা হয়েছিলো। কিন্তু রহস্যজনক ভাবে ব্রিজের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অথচ ব্রিজ নির্মাণ করলে একদিকে খরচ কম হত অন্যদিকে নদীর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকতো। বাঁধ নির্মাণের সময় ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান মরহুম আব্দুস সালাম সিকদারসহ হাজার হাজার কৃষক মানববন্ধনসহ প্রতিবাদ সমাবেশ করেছিলেন। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোডর্র খামখেয়ালীতে পরিকল্পনাহীন এ বাঁধ বরইতলা নদীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।'
এ বিষয়ে নদী বাঁচাও আন্দোলন পটুয়াখালী জেলা কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মানস কান্তি দত্ত ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'প্রবাহমান নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর বুক ভরাট করা নদী হত্যার শামিল। আইনের দৃষ্টিতে নদী জীবন্ত সত্ত্বা। এ বাঁধ নির্মানের করে পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকাবাসীর উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশী করেছে বলে মনে হচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা এলাকাটি পরির্দশন করে বাঁধ অপসারণের যথাযথ পদক্ষেপ নিবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। একই সাথে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করেন তিনি।
এ বিষয়ে কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহ আলম ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'আমি এখানে আসার পর এ ধরনের কোনো বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড সকল সময় স্থানীয়দের চাহিদার ভিত্তিতে কাজ করে থাকে। বরইতলা নদীর ভরাট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সরেজমিনে পরিদর্শন করবো।'
তিনি বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় অনেক সময় ভাটায় পানি নামতে পারে না। ফলে স্লুইস গেটের অভ্যন্তরের খাল এবং ছোট নদীগুলোতে পলি পড়ে যায়। এগুলো ড্রেজিং এবং খননের মাধ্যমে সচল রাখা সম্ভব। তবে পর্যাপ্ত বাজেটের অভাবে কাজগুলো সঠিক সময়ে করা সম্ভব হয়না। বরইতলা খালের প্রবাহ ঠিক রাখতে পানি উন্নয়ন বোর্ড অচিরেই কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।'