BREAKING: |
বাংলাদেশের অর্থনীতি যেন এক চলমান নদী। কখনো স্রোত তীব্র, কখনো শান্ত, আবার কখনো খরায় ভোগা। সেই নদীর প্রাণ হলো রিজার্ভ—যেখানে জমে থাকে আমাদের আশা, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের ভবিষ্যৎ। অথচ আজ সেই নদীর জলে ভাটা নেমেছে। যে রিজার্ভ একদিন গর্বের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল, আজ তা যেন খরস্রোত হারিয়ে নিস্তেজ। কেন এমন হলো?
উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায়, পেছনে দাঁড়িয়ে আছে এক অদৃশ্য শত্রু—হুন্ডি। এটি যেন এক অশরীরী দানব, যে প্রবাসীদের ঘামঝরা পরিশ্রমে উপার্জিত টাকা গিলে নিচ্ছে, অথচ দেশের ভাণ্ডারে তার কোনো ছাপ রাখছে না।
হুন্ডি এক প্রলোভনের ফাঁদ। প্রবাসী শ্রমিক যখন দূর দেশে অমানুষিক পরিশ্রমে ডলার উপার্জন করেন, তখন তারা সহজ পথ খোঁজেন। ব্যাংকের দীর্ঘসূত্রিতা, কম রেট আর কাগজপত্রের ঝক্কি তাদের নিরুৎসাহিত করে। তখন হুন্ডি ব্যবসায়ী হাত বাড়িয়ে দেয়—“ভাই, আমি বেশি রেট দেবো, মুহূর্তেই টাকা পৌঁছে যাবে ঘরে।” প্রবাসী ভাবেন, পরিবার দ্রুত টাকা পাবে, আর তিনি লাভ করবেন কিছু অতিরিক্ত টাকা।
কিন্তু এই সামান্য লাভের বিনিময়ে যে ক্ষতি হয়, তা গোটা দেশের কপালে কালো দাগ হয়ে জমে থাকে। ব্যাংকের ভাণ্ডার খালি হয়, রিজার্ভ কমে যায়, ডলারের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়, মূল্যস্ফীতি বাড়ে—শেষ পর্যন্ত ভোগান্তিতে পড়েন দেশের সাধারণ মানুষ।
অর্থনীতিকে যদি আমরা একটি দেহের সাথে তুলনা করি, তবে রিজার্ভ হলো তার হৃদস্পন্দন। সেই স্পন্দন যদি দুর্বল হয়ে যায়, তবে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ অচল হয়ে পড়ে। হুন্ডির কারণে আজ সেই হৃদস্পন্দন দুর্বল। আমরা বাজারে গিয়ে দেখি দ্রব্যমূল্য উর্ধ্বগতি, ব্যবসায়ীরা ডলার পাচ্ছেন না, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাচ্ছেন। অথচ প্রবাসী আয় তো কমেনি! কিন্তু সেই অর্থের স্রোত বৈধ নদীপথে না এসে চলে যাচ্ছে হুন্ডির অন্ধকার গলিতে।
এই প্রশ্নের উত্তর শুধু এককভাবে দেওয়া যায় না। ব্যাংকিং ব্যবস্থার জটিলতা যেন প্রবাসীদের নিরুৎসাহিত করছে। কালোবাজারি সিন্ডিকেট মুদ্রাকে খেলনার মতো ব্যবহার করছে। সরকারের নজরদারির ঘাটতি আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অমনোযোগিতা হুন্ডিকে আরও সাহসী করে তুলছে। এ যেন আমরা সবাই মিলে দানবকে খাওয়াচ্ছি, অথচ বুঝতেই পারছি না সে আমাদের বুকের রক্ত শুষে নিচ্ছে।
যদি সত্যিই আমরা রিজার্ভকে বাঁচাতে চাই, তবে প্রথমে হুন্ডিকে রুখতেই হবে। প্রবাসীর ঘামঝরা ডলার বৈধ পথে আসতে হবে। এজন্য ব্যাংকিং চ্যানেলকে দ্রুত, সহজ আর প্রবাসীবান্ধব করতে হবে। বৈধ পথে টাকা পাঠালে বাড়তি প্রণোদনা দিতে হবে। কালোবাজারি ও হুন্ডি সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। ডলারের সরকারি রেটকে বাজারের সাথে বাস্তবসম্মত করতে হবে।
সর্বোপরি, প্রবাসীদের বোঝাতে হবে—তাদের বৈধ রেমিট্যান্সই দেশের অর্থনীতির ভরকেন্দ্র।
বাংলাদেশের রিজার্ভ আশানুরূপ নয়—এটা কেবল অর্থনীতির খবর নয়, এটা জাতির স্বপ্নভঙ্গের গল্পও বটে। হুন্ডির দানব যদি আমরা এখনই দমন না করি, তবে আমাদের অর্থনীতির নদী শুকিয়ে যাবে, হৃদস্পন্দন থেমে যাবে। প্রবাসীর ঘামঝরা ডলারকে যদি আমরা বৈধভাবে আনতে পারি, তবে আবারও রিজার্ভ ফুলে-ফেঁপে উঠবে, অর্থনীতির দেহে নতুন প্রাণসঞ্চার হবে।
দেশের রিজার্ভকে বাঁচাতে হলে হুন্ডির কবল থেকে মুক্ত হতে হবে—এখনই, আজই।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আরএন