বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। তবে এই স্বাধীনতা কখনোই সীমাহীন নয়। প্রতিটি স্বাধীন মত প্রকাশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে দায়িত্ব, বিবেক এবং সামাজিক নৈতিকতার ভার। আজকের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমরা প্রায়ই দেখি, অনেকে স্বাধীনতার নাম করে যা খুশি বলে ফেলছেন। আবার কোথাও দলীয় শৃঙ্খলার নামে ভিন্নমতকে দমন করা হচ্ছে। এই দ্বৈত চ্যালেঞ্জই আমাদেরকে চিন্তা করতে বাধ্য করে- বাকস্বাধীনতা আসলে কি সীমাহীন স্বাধীনতা, না কি এর সঙ্গে জড়িত আছে একটি দায়িত্বশীল প্রক্রিয়া?
ইতিহাস আমাদের শেখায়, যেখানে বাকস্বাধীনতা নেই, সেখানে গণতন্ত্র কখনোই টিকে থাকে না। ফরাসি বিপ্লবের আগুন, মার্কিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- সবই সেই সময়ের প্রমাণ যেখানে মানুষের কণ্ঠকে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
তবে ইতিহাস আরও দেখায়, স্বাধীনতা যখন সীমাহীন হয়ে যায় তখন তা সহিংসতা, বিভাজন এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। তাই গণতন্ত্রের শিরদাঁড়া হিসেবে সত্য এবং দায়িত্বের ভারসাম্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে সংবিধান স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছে যে, এই স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, সামাজিক শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতার সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না। অর্থাৎ সংবিধানই বোঝাচ্ছে, বাকস্বাধীনতা মানে সীমাহীনতা নয় বরং এটি দায়িত্বের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বাস্তব জীবনে আমরা প্রায়ই দেখি এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বাধীনতা এবং দায়িত্বের মধ্যকার লড়াই ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করছে। যে যার মতো যা ইচ্ছে তাই বলছে। বিশেষ করে দেশের বাহিরে থাকা কিছু ব্যক্তি মনে হচ্ছে অনলাইন প্লাটফর্ম থেকেই দেশ চালাচ্ছে কি ভাষা রে ভাই। কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ কি ওই সব অসভ্য কথা বলতে পারে? এদেরকে জ্ঞানপাপী বললেও বেশি বলা হবে না।
রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের প্রাণ। তাদের ভেতরে শৃঙ্খলা থাকাটাই শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং সংগঠনের মূল ভিত্তি। তবে দায়িত্বহীন স্বাধীনতা, যার মধ্যে ব্যক্তিগত আক্রোশ, বিদ্বেষ বা স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা থাকে, দলকে দূর্বল করে। আবার দলীয় শৃঙ্খলার নামে ভিন্নমতকে দমন করাও সমান ভাবে ক্ষতিকর। গণতন্ত্রে শক্তি আসে সমালোচনা ও বিভিন্ন মতামতের গ্রহণযোগ্যতা থেকে। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে শাসক দলের এমপিরাও নিজেদের দলের নীতির সমালোচনা করতে পারেন এবং তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের সদস্যরা ভিন্নমত পোষণ করলেও দল তাদের বহিষ্কার করে না। বরং সেই মতামত আলোচনার মধ্যে আসে। ভারতেও দলের হুইপ অমান্য করলে শাস্তি পাওয়া যায়, তবে সমালোচনামূলক কণ্ঠকে দমন করা হয় না।
কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায়, দলীয় শৃঙ্খলার নামে কখনো কখনো সত্যকথা চেপে দেওয়া হয়, আবার স্বাধীনতার নামে দায়িত্বহীন মন্তব্যে জনগণ বিভ্রান্ত হয়। সেটিও আবার ভিআইপি ব্যক্তি থেকে অখ্যাত ব্যক্তি পর্যন্ত।
আজকের সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রায়ই স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারের সংঘর্ষের মঞ্চ হয়ে উঠেছে। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে মানুষ মনে করে যা খুশি বলার অধিকার আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ভুয়া খবর ছড়ানো, উসকানিমূলক মন্তব্য এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ সমাজকে বিভাজিত করছে।
২০২৩ সালে সাইবার ক্রাইম ট্রাইবুনালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে প্রায় ৭ হাজার মামলা দায়ের হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)'র সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ মানুষ মনে করেন রাজনৈতিক দলে ভিন্নমত সহ্য করা হয় না। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০২৪-এ বাংলাদেশ ১৮০ দেশের মধ্যে ১৬৩তম। এই সব উপাত্তই প্রমাণ করছে যে, স্বাধীন মত প্রকাশ এখনও চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাকস্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ হলো সত্য বলার সাহস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, “বাকস্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য হলো সত্যকে সামনে আনা। কিন্তু আজ আমরা হয় ‘যা খুশি তাই বলা’ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারে আটকে যাচ্ছি, নয়তো দলীয় আনুগত্যের কাছে বিবেক বিসর্জন দিচ্ছি।”
টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যুক্তি দিয়ে বলেন, “স্বাধীনতার সীমা টানতে হবে যুক্তির ভিত্তিতে, ক্ষমতার স্বার্থে নয়।”
আন্তর্জাতিক ভাবে নেলসন ম্যান্ডেলা একবার বলেছেন, “Freedom of speech is not to say whatever you like, but to say what is just and responsible.” এ উক্তিটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্য এবং দায়িত্বের ভারসাম্যই স্বাধীনতার মূল মন্ত্র।
স্বাধীন মত প্রকাশ ও দলীয় শৃঙ্খলা একে অপরের পরিপূরক। স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচার গণতন্ত্রকে দুর্বল করে, আবার শৃঙ্খলার নামে মত দমনও সমানভাবে ক্ষতিকর। ইতিহাস এবং সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা উভয়ই দেখিয়েছে, যে সমাজে এই ভারসাম্য হারায়, সেখানে গণতন্ত্র দুর্বল হয়। তাই আমাদের দায়িত্ব হলো, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও দলীয় শৃঙ্খলার মধ্যে একটি সুচিন্তিত ভারসাম্য স্থাপন করা।
আন্তর্জাতিক উদাহরণ থেকে শেখা যায়, কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য দায়িত্বশীল মত প্রকাশ অপরিহার্য। যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীন মত প্রকাশের সংস্কৃতি শক্তিশালী, তবে আইনি কাঠামো আছে যা গুজব ও মিথ্যা তথ্য প্রচারকে দমন করে। যুক্তরাজ্যে পার্লামেন্টে সমালোচনামূলক বক্তব্য গণতান্ত্রিক পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিক। ইউরোপের অনেক দেশে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারকে সামাজিক ও আইনি দায়বদ্ধতার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। এরা দেখিয়েছে, স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বের সমন্বয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। স্বাধীন, অনুসন্ধানী এবং তথ্যভিত্তিক সাংবাদিকতা বাকস্বাধীনতার সঠিক চর্চা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু অনৈতিক সাংবাদিকতা, অর্থের প্রলোভন বা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সত্য উচ্চারণ প্রায়শই দমন হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য যাচাইহীন সংবাদ, গুজব এবং উসকানিমূলক কণ্ঠরূপী বার্তা ছড়িয়ে দেয়। নাগরিকদের সচেতন হওয়া এবং দায়িত্বশীল কণ্ঠ ব্যবহার করা এখন সময়ের দাবি।
গণতন্ত্র টিকে থাকে সত্য ও দায়িত্বের ভারসাম্যে। এ জন্য আমাদের প্রয়োজন আইনি সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, গণমাধ্যম আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং দায়িত্বশীল নাগরিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দলগুলোকে ভিন্নমতকে শত্রু নয়, পরামর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। গণমাধ্যমকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও তথ্যভিত্তিক রাখার জন্য সমর্থন দিতে হবে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং গণতান্ত্রিক শিক্ষা নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।
বাকস্বাধীনতা গণতন্ত্রের প্রাণ। তবে এটি সীমাহীন নয় বরং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে জড়িত। যা খুশি বলে বিভাজন সৃষ্টি করা স্বাধীনতা নয়। আবার দলীয় শৃঙ্খলার নামে সত্যকে চেপে রাখা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র টিকে থাকে সত্য ও দায়িত্বের ভারসাম্যে। তাই বলা যায়- যা খুশি বলার নাম স্বাধীনতা নয়; দায়িত্বশীল কণ্ঠই প্রকৃত স্বাধীনতার প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশের জনগণ, রাজনৈতিক দল, সাংবাদিকতা এবং নাগরিক সমাজ- সবাই মিলিত ভাবে এই ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র গড়ে উঠবে তখনই, যখন সত্য বলার সাহস থাকবে, কিন্তু সেই সাহস থাকবে দায়িত্বের সীমার মধ্যে। স্বাধীনতা এবং শৃঙ্খলার এই সমন্বয়ই আমাদের জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে এবং সমাজকে আলোকিত রাখবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ডেইলি অবজারভার।