ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী আসমা আক্তার লিজার মৃত্যু যেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার নির্মম প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চলতি বছরের ১৫ আগস্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে অসুস্থ হয়ে পড়েন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী লিজা। কিন্তু হলে কোনো চিকিৎসক ছিলেন না, ছিল না স্ট্রেচার বা হুইলচেয়ার। অবশেষে বিলম্বে হাসপাতালে নেওয়া হলেও তাকে আর বাঁচানো যায়নি।
এই মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ছিল—অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সংস্কার আসবে, নতুন উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, সেই প্রত্যাশা কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। ঢাবির চিকিৎসা সংকট একই রকম থেকে গেছে, বরং আরও প্রকট হয়ে উঠছে।
মৌলিক চিকিৎসা সেবার অভাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের হলগুলোতে এখনো নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম। অধিকাংশ হলে জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী যেমন—স্ট্রেচার, হুইলচেয়ার, অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হলে কোনো ডিউটি ডাক্তার নেই, অসুস্থ হলে রাতের বেলা সাহায্য পাওয়াও দুষ্কর।
লিজার হলের শিক্ষার্থী উম্মে সুহালা সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ জানিয়ে লিখেন যে লিজার মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো হলে চিকিৎসার অবহেলা।
উম্মে সুহালা জানান যে হলে একটি ডাক্তার থাকলেও প্রায়ই তাকে পাওয়া যায় না। সেখানে মাত্র তিনটি চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে—নাপা, এন্টাসিড ও প্রেশার মাপার যন্ত্র। শ্বাসকষ্টে ভুগা শিক্ষার্থীর প্রেশার মাপা হয়। জরুরি পরিস্থিতিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এম্বুলেন্স আসতেও অনেক দেরি হয়। আর হলে স্ট্রেচারের অভাব থাকে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, লিজার হৃদয়ে টিউমার ছিল, ফুসফুসে পানি জমে এবং ব্রেইনে সংক্রমণ হয়েছে। নিয়মিত চেকআপ বা জরুরি ব্যবস্থা ছিল না।
“বছরে কোটি কোটি টাকার স্বাস্থ্যবীমার নামে রমরমা ব্যবসা চলে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষা করতে কিছুই করা হয় না,” উম্মে সুহালা বলেন।
বঙ্গমাতা হলের আরেক শিক্ষার্থী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “লিজার মৃত্যুর পর প্রশাসন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে কিছুই পরিবর্তন হয়নি। আমরা এখনও ভয়ে থাকি। রাতে কেউ অসুস্থ হলে কীভাবে তাকে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হবে?”
জরুরি অবকাঠামোর করুণ চিত্র
ঢাবির মেডিকেল সেন্টার নিজেই রয়েছে শোচনীয় অবস্থায়। সেখানে মাত্র তিনটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও তার মধ্যে দুটি অচল। ফলে কার্যত একটি অ্যাম্বুলেন্স দিয়েই প্রায় চল্লিশ হাজার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।
শুধু তাই নয়, চলমান ডেঙ্গু সংকটের সময়েও মেডিকেল সেন্টারে ডেঙ্গু পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ রাজধানীর প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই ন্যূনতম ডেঙ্গু টেস্টিং সুবিধা রয়েছে।
ভিসির অজুহাত বনাম বাস্তবতা
শিক্ষার্থীদের অভিযোগের মুখে ঢাবি উপাচার্য ডেইলি অবজারভারের কাছে স্বীকার করেছেন যে চিকিৎসা ব্যবস্থার ঘাটতি ভয়াবহ।
তিনি বলেন, “বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট এমনই সংকটপূর্ণ যে, মেডিকেল সেন্টারের রক্ষণাবেক্ষণের টাকাও নেই। একটা অ্যাম্বুলেন্সের টায়ার নষ্ট হয়ে গেলে নতুন টায়ার কেনারও বরাদ্দ নেই।”
তবে তিনি দাবি করেন, দীর্ঘ আলোচনা শেষে তুরস্কের উন্নয়ন সংস্থা টিকা (Turkish Cooperation and Coordination Agency) প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্তুজা মেডিকেল সেন্টারে আধুনিক অবকাঠামো, আইসিইউ সুবিধা এবং নতুন অ্যাম্বুলেন্স সরবরাহ করবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮৪১ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পেও চিকিৎসা খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, “আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে মেডিকেল সেন্টারকে আধুনিক রূপে রূপান্তর করা সম্ভব হবে।”
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—যখন শিক্ষার্থীরা আজকে চিকিৎসাহীনতায় ভুগছে, তখন ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি তাদের জন্য কী সান্ত্বনা বহন করে? লিজার মৃত্যুর পরপরই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল, অথচ প্রশাসন সেই দায় এড়াচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতির আড়ালে।
শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ—রাত ১০টার পর হলে আটকে পড়লে তারা কোনো চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া যায় না। জরুরি অবস্থায় হলে টিউটররা সাড়া দেন না, এমনকি কর্মচারীদেরও পাওয়া যায় না।
রোকেয়া শিক্ষার্থী সায়মা খান বলেন, “রাতে কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাদের অসহায় হয়ে পড়তে হয়। বাইরে বের হওয়া যায় না, হলে কোনো ডাক্তার নেই, আর মেডিকেল সেন্টারে পৌঁছানোও কঠিন। লিজার মৃত্যুর পরও এই বাস্তবতা অপরিবর্তিত।”
ফার্মেসির অভাব: আরেকটি বেদনাদায়ক বাস্তবতা
পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একমাত্র ক্লাব ছাড়া কোনো ফার্মেসি নেই। হলে বা হলপাড়ায়ও নেই ওষুধ কেনার সুযোগ। ফলে শিক্ষার্থীরা রাতের বেলায় জরুরি ওষুধ কিনতে পুরোপুরি অক্ষম হয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে উপাচার্য জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিম (SMT) মিটিংয়ে ক্লাবের হেলথ মার্ট থেকে উত্তরপাড়া ও দক্ষিণপাড়ায় দুটি আউটলেট চালুর প্রস্তাব উঠেছে। এছাড়া কলেজ রোডে অবস্থিত সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল থেকে ঔষধ ও সেবা নেওয়ার ব্যাপারে আলাপ হয়েছে। হাসপাতালের মহাপরিচালককেও এ বিষয়ে অনুরোধ করা হয়েছে।
তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, এ ধরনের প্রস্তাব বহুবারই এসেছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। লিজার মৃত্যুর পরও ফার্মেসি খোলার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
প্রশাসনিক টালবাহানা
মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও শিক্ষার্থীরা অভিযোগ তুলেছে। কর্তব্যে অবহেলা, দায়িত্বে গাফিলতি ও দুর্ব্যবহারের মতো বিষয়গুলো এখন তদন্তাধীন। এজন্য প্রশাসন একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করেছে।
তবে এই কমিটি গঠনের কারণে অনেক চিকিৎসককে অন্য দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, ফলে চিকিৎসা সংকট আরও বেড়েছে।
অবশেষে বিশেষ অনুমতিতে দুইজন নতুন চিকিৎসক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশাকে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন—দুইজন ডাক্তার নিয়োগে কি এত বড় সংকটের সমাধান সম্ভব?
বাজেট বনাম শিক্ষার্থীদের জীবন
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বারবার বাজেট সংকটের অজুহাত দিচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের যুক্তি হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক বাজেট যদি ২৮৪১ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে, তবে কেন মেডিকেল খাতে জরুরি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে না?
শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব আদিব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ডাকসু নির্বাচনের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, কিন্তু একটি স্ট্রেচার কেনার টাকা নেই। এটা শিক্ষার্থীদের সাথে প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়।”
প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতা
ঢাবি উপাচার্য বলেন, “হলগুলোর ঘাটতি পূরণ করতে হলে বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি, তবে কাঠামোগত পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ।”
কিন্তু সময়সাপেক্ষ প্রতিশ্রুতির আড়ালে শিক্ষার্থীদের জীবন যে ঝুঁকির মুখে, সেই দায় কে নেবে? লিজার মৃত্যু কি কোনো শিক্ষা দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, যেখানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী স্বপ্ন বুনে। অথচ তাদের সবচেয়ে মৌলিক অধিকার, জরুরি চিকিৎসা সুবিধা, সেই প্রতিষ্ঠানেই উপেক্ষিত।
লিজার মৃত্যু একটি করুণ সতর্কবার্তা ছিল। কিন্তু সেই সতর্কবার্তাকে কাজে লাগিয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতির আড়ালে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে।
মৌলিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, ফার্মেসি, ডিউটি ডাক্তার ও জরুরি সাড়া প্রদানের ব্যবস্থা না হলে আবারও নতুন কোনো লিজার জীবন নিভে যেতে পারে। আর তখনও হয়তো প্রশাসন বলবে, “আমরা শিগগিরই ব্যবস্থা নিচ্ছি।”