Thursday | 23 October 2025 | Reg No- 06
Epaper | English
   
English | Thursday | 23 October 2025 | Epaper
BREAKING: কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি জামায়াতের, জানালেন প্রধান উপদেষ্টাকে      সেন্টমার্টিন ভ্রমণে মানতে হবে ১২ নির্দেশনা      কোনো অন্যায় চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না নির্বাচন কমিশন: সিইসি      আত্মসমর্পণকারী সেনা কর্মকর্তারা নির্দোষ, অপরাধীরা পালিয়েছে: আইনজীবী      বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়নি, চেয়েছে নিরপেক্ষ ভূমিকা: আইন উপদেষ্টা      শেখ হাসিনাসহ পলাতকদের হাজিরে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ      নাইজেরিয়ায় জ্বালানি ট্যাঙ্কার বিস্ফোরণে নিহত ৩৮      

চলনবিলের পালাগান বিলুপ্তির পথে: হারিয়ে যাচ্ছে বেহুলা-লখিন্দরের লোকস্মৃতি

Published : Wednesday, 30 July, 2025 at 4:39 PM  Count : 282

চলনবিল একসময় ছিল বাংলার লোকসংস্কৃতির এক জীবন্ত কেন্দ্র। বিশেষ করে পালাগান ছিল এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক প্রাণ। নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও আশপাশের এলাকাগুলোতে বেহুলা-লখিন্দর, মনসামঙ্গল, মহুয়া, ভাদু ও ধনপতির পালা—এসবই ছিল গ্রামীণ মানুষের আত্মার খোরাক। কিন্তু আজ সেই পালাগান হারিয়ে যেতে বসেছে।

এক সময় চলনবিলাঞ্চলের গ্রামে গ্রামে ভাদ্রমাসে পালাগানের আসর বসত। নৌকাবাইচ, গ্রামীণ মেলা, হারমোনিয়ামের সুরে মেতে উঠত পুরো জনপদ। পালাগানের মাধ্যমে ফুটে উঠত প্রেম, বিরহ, নারীর আত্মত্যাগ, সামাজিক অবিচার ও প্রতিরোধের কাহিনি। কিন্তু প্রযুক্তি-নির্ভর বিনোদন আর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে এই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।

চলনবিলের পালাগান ছিল কেবল বিনোদন নয়, ছিল গ্রামীণ জীবনের জীবন্ত নাট্যরূপ। লোকশিল্পীদের গলায় ভেসে আসত ইতিহাস, দর্শন, প্রেম ও প্রতিবাদের বার্তা। বিশেষ করে বেহুলা-লখিন্দরের পালা নারীর সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের অনন্য নিদর্শন হয়ে উঠেছিল। পালাকারদের দলগুলো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে পালা পরিবেশন করতেন।

এক বেসরকারি জরিপের তথ্য মতে, ২০০৫ সালে নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে প্রায় ২৭০টি পালাগানের দল সক্রিয় ছিল। ২০১৫ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, সেই সংখ্যা নেমে আসে ৮০-তে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের হিসেবে তা ১৫টির নিচে নেমে এসেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পালাগান হারিয়ে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে: প্রযুক্তির আগ্রাসন: টেলিভিশন, ইউটিউব, ফেসবুকসহ ডিজিটাল বিনোদন পালাগানের স্থান দখল করে নিয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট: পালাকারদের পেশায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকে পেশা বদল করে কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর বা রিকশাচালক হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় অবহেলা: সরকারিভাবে কোনো রকম পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় এই শিল্প টিকে থাকেনি। প্রজন্মগত বিচ্ছিন্নতা: বর্তমান তরুণ প্রজন্ম পালাগানের নামও জানে না। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও কোনো পরিচয় ঘটানো হচ্ছে না। নগরায়ণ ও জায়গার সংকট: খোলা মাঠ, মেলা বা পালা পরিবেশনের স্থানগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে বাজার, রাস্তা বা অন্যান্য আধুনিক স্থাপনায়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, “পালাগান একসময় বাংলার গ্রামীণ সমাজের আত্মা ছিল। এই ধারার পতন আমাদের সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব নির্দেশ করে।”

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ড. ফারজানা জুঁই বলেন, “চলনবিলের মতো অঞ্চলগুলো হারিয়ে গেলে আমাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে।”

অপরদিকে লোকসংস্কৃতি গবেষক অধ্যাপক তাহমিনা ফেরদৌস বলেন, “পালাগানে নারীর প্রতিবাদ, প্রেম ও সাহসিকতার যে প্রতিচ্ছবি আমরা পেতাম, তা আজ আর কোথাও পাওয়া যায় না। সংস্কৃতির এই পাঠশালা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ৭৮ বছর বয়সী প্রবীণ পালাকার আবদুল গফুর জানান, “আগে বছরে ২০টি পালায় ডাক পেতাম। এখন দুই বছরেও একটি পালার আমন্ত্রণ পাই না।”

পাবনার আটঘরিয়ার পালাগান শিল্পী রওশন আলী বলেন, “কেউ আর পৃষ্ঠপোষকতা করে না। এখন মজুরি করে বেঁচে আছি। পালা গাওয়ার সময় আর নেই।"

চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থের লেখক আব্দুল হামিদের তথ্য মতে, চলনবিল যাদুঘরে কিছু লোকসাংস্কৃতিক উপকরণ সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে রয়েছে বেহুলা-লখিন্দরের পালার ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র, পোশাক, প্রাচীন পুঁথি ও মুখোশ।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাদুঘরের দেয়ালে টাঙানো কিছু স্মৃতি দিয়ে সংস্কৃতি বাঁচে না। এর জন্য দরকার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সচেতন প্রয়াস। 

তাই বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা লোকসংস্কৃতি পুনরুদ্ধারে কিছু সুপারিশ করেছেন: লোকসংস্কৃতি সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন। স্কুল-কলেজে ঐচ্ছিক পাঠ্যক্রমে পালাগান অন্তর্ভুক্ত। জেলা-উপজেলায় ‘লোকগান উৎসব’ আয়োজন। পালাকারদের মাসিক সম্মানী ও বয়স্ক ভাতা চালু। ডিজিটাল আর্কাইভ গঠন ও গণমাধ্যমে প্রচার। গবেষণায় সরকারি অনুদান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লোকসংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা।

চলনবিল আজ তার নিজস্ব সাংস্কৃতি হারিয়ে কাঁদে—কিন্তু সেই কান্না শুনতে পায় না কেউ। প্রযুক্তির কোলাহলে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির ঘ্রাণ, বেহুলার গান, প্রতিরোধের সুর। পালাগান হারিয়ে যাওয়ার অর্থ শুধুই সাংস্কৃতিক ক্ষয় নয়—এটি আত্মপরিচয়ের মাটিতেও ধস নামার পূর্বাভাস।

প্রশ্ন হলো, আমরা কি আবার বেহুলার চোখ দিয়ে নিজস্ব সাংস্কৃতির স্বপ্ন দেখতে পারি না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আজই উদ্যোগ নিতে হবে, গাইতে হবে, লিখতে হবে, শুনাতে হবে—কারণ হারিয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের থামতে হবে।

এসআর
সম্পর্কিত   বিষয়:  চলনবিল  


LATEST NEWS
MOST READ
Also read
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000.
Phone: PABX- 41053001-06; Online: 41053014; Advertisement: 41053012.
E-mail: [email protected], news©dailyobserverbd.com, advertisement©dailyobserverbd.com, For Online Edition: mailobserverbd©gmail.com
🔝
close