Sunday | 12 October 2025 | Reg No- 06
Epaper | English
   
English | Sunday | 12 October 2025 | Epaper
BREAKING: ট্রাইব্যুনালের ১৫ অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তা সেনা হেফাজতে      জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান ২ দিন পেছালো      জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কর্মী সমাবেশে উত্তেজনা, ছত্রভঙ্গ করলো পুলিশ       এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার টাকার মধ্যে হওয়া উচিত: জ্বালানি উপদেষ্টা      দু’একজন উপদেষ্টা ও প্রশাসন একটি দলকে ক্ষমতায় নেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে: পরওয়ার      এবারের নির্বাচনে আইনের শাসন কাকে বলে দেখাতে চাই: সিইসি      ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ১-০ ব্যবধানে আর্জেন্টিনার দুর্দান্ত জয়      

গণতন্ত্রের ছায়া নাকি পক্ষপাতের চেতনা?

Published : Saturday, 19 July, 2025 at 5:11 PM  Count : 227

গণতন্ত্রের আদর্শ যেখানে রাজনৈতিক বৈচিত্র্য ও জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা, সেখানে আজ বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে এক অদৃশ্য পক্ষপাতমূলক বাস্তবতা। এক অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কীভাবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, প্রশাসনিক সহায়তা ও জনসম্পদ ব্যবহার করছে, তা অবাক করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচিতে বারবার বাধা, অনুমতির নামে হয়রানি কিংবা পুলিশি শক্তি প্রয়োগ এখন নিত্যদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ অনিবন্ধিত একটি দল রাষ্ট্রীয় সুবিধায় জেলা থেকে জেলায় গণসংযোগ করছে, সম্মেলন করছে, এমনকি প্রচারমাধ্যমেও জায়গা পাচ্ছে প্রায় অনায়াসে। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, "একটি দল যদি নির্বাচন কমিশনের স্বীকৃত না হয়, তবে সে দলের এমনতরো জনসমর্থন প্রদর্শন, রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সহায়তা পাওয়া, এটি প্রশাসনিক পক্ষপাত ছাড়া আর কিছুই নয়।"

বাংলাদেশে বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪১টি। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অনুমোদন ব্যতীত কোনো দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে না এবং সরকারি সুবিধা গ্রহণ করতে পারে না। তথাপি বর্তমানে একটি ‘অবৈধভাবে স্বীকৃত’ দল প্রতিটি জেলায় গণসংযোগ করছে, শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে সভা করছে, এবং তাদের শীর্ষ নেতারা হেলিকপ্টারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক রিসার্চ (BCDR)-এর ২০২৩ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, ৬৪ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, বর্তমানে প্রশাসন রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট; এবং ৫৭ শতাংশ নাগরিক বিশ্বাস করেন, একটি দল রাষ্ট্রীয় সুযোগ নিচ্ছে অনিবন্ধিত হয়েও। একইভাবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০২২ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৬৮ শতাংশ নাগরিক মনে করেন নির্বাচনী প্রক্রিয়া সরকারের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হয় এবং ৪১ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, তারা ভোট দেয়ার আগেই ফল নির্ধারিত থাকে। এই পরিসংখ্যানগুলোই বলে দেয়, জনগণের গণতান্ত্রিক আস্থার গ্রাফ নেমে এসেছে গভীর নিম্নমুখে।

জনগণের করের টাকায় পরিচালিত প্রশাসন যদি শুধুমাত্র নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়, তাহলে তা গণতন্ত্র নয়, বরং এক ধরনের রাজনৈতিক দাসত্ব। হেলিকপ্টার ভাড়া, শত শত গাড়ির তেল, নিরাপত্তা—এসব ব্যয়ের উৎস নিয়ে নির্বাচন কমিশন বা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিরুত্তর। তাহলে প্রশ্ন জাগে—কাদের আশীর্বাদে চলছে এসব? 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা হোসেন বলেন, "রাষ্ট্র যদি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে করের টাকায় সুবিধা দেয়, আর অন্যদের দমন করে, তবে তা গণতন্ত্র নয়, বরং এক ধরনের আধা-একনায়কতান্ত্রিক ছদ্মব্যবস্থা।" 

গণতন্ত্রে সকল রাজনৈতিক শক্তির জন্য সমান সুযোগ থাকা জরুরি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, একশ্রেণির রাজনৈতিক কর্মসূচিকে প্রশাসনিকভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে, আর অন্যদের দমন করা হচ্ছে। এতে যে ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ গড়ে উঠছে, তা গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল করছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, প্রশাসনের পক্ষ থেকে র‌্যাব, পুলিশ, এমনকি ডিসি অফিস পর্যন্ত ওই দলের সভা-সমাবেশে নিরাপত্তা দিচ্ছে। অন্যদিকে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মিছিলে বাধা, গ্রেফতার, মামলা ও হয়রানি চলছে। এমন বৈষম্যমূলক আচরণ রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নওগাঁ, বরিশাল ও কুমিল্লায় এমন একাধিক ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে অনিবন্ধিত দলের সভার রাস্তায় ব্যারিকেড না থাকলেও, অন্যদের জন্য থাকে অনুমতির শর্তাবলি ও পুলিশের নিষেধাজ্ঞা। এমন এক পরিস্থিতিতে প্রশাসন নিরপেক্ষ সংস্থা না থেকে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শক্তির 'লজিস্টিক পার্টনার' হয়ে উঠছে। যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচর্চায় চরম আপত্তিকর এবং আইন বহির্ভূত।

বিশ্লেষকরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, এই অনিবন্ধিত দলটি হয়তো ভবিষ্যতের কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার ‘বিকল্প শক্তি’ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। ইতিহাস বলছে, একদা হিটলারও গণতন্ত্রের পদ্ধতি ব্যবহার করেই একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আ ক ম জামাল উদ্দিন বলেন, "যখন গোপনে এক দলকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র কাজ করে, তখন গণতন্ত্র আর জনগণের হাতে থাকে না—তা পরিণত হয় ছদ্মবেশী কর্তৃত্ববাদের খেলায়।" 

এই পরিস্থিতি নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিচ্ছে কিনা, সে প্রশ্নও এখন সাংবাদিক মহলে, বুদ্ধিজীবী মহলে উচ্চারিত হচ্ছে।

যখন এক দলকে সভা করার অনুমতি দেওয়া হয়, কিন্তু অন্যদের সমাবেশে বাধা দেওয়া হয়, তখন মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে—রাষ্ট্র কি সকল নাগরিকের সমান? এই প্রশ্নই ধ্বংস করে জনগণের আস্থা। আর গণতন্ত্রে জনগণের আস্থা ভেঙে পড়া মানেই পুরো কাঠামোর পতন। রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত একটি এনজিওর এক জরিপে দেখা যায়, ৪৯ শতাংশ তরুণ ভোটার মনে করে, তাদের ভোট কোনো পরিবর্তন আনে না। ৩৫ শতাংশ তরুণ প্রথমবারের ভোটেই অংশ নিতে আগ্রহী নয়। গণতন্ত্র যদি কেবল নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়, এবং সেই নির্বাচনের মাঠই যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তবে তা প্রকৃত গণতন্ত্র নয়। এটি হয় শুধুমাত্র ‘প্রতীকী গণতন্ত্র’।

বাংলাদেশ সংবিধানের ২০(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, "রাষ্ট্রের সকল কার্যাবলি জনগণের জন্য এবং জনগণের দ্বারা পরিচালিত হইবে।" এছাড়া ৩৮ অনুচ্ছেদ বলছে, "প্রত্যেক নাগরিকের শান্তিপূর্ণভাবে ও অস্ত্রবিহীনভাবে সমাবেশ করার অধিকার থাকবে।" এই অনুচ্ছেদগুলোর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হলো, কোনো দলকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া এবং অপর দলকে দমন করা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।

আন্তর্জাতিকভাবে গণতন্ত্রের মানদণ্ড নির্ধারণ করে থাকে সংস্থাগুলো যেমন Freedom House, Economist Intelligence Unit ইত্যাদি। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের স্কোর, Freedom House 2024 এ ৪২/১০০ — "Partly Free" এবং EIU Democracy Index 2023 অনুযায়ী বাংলাদেশ রয়েছে ৭৫তম অবস্থানে — "Hybrid Regime" হিসেবে। এই সূচকগুলোই প্রমাণ করে, বাংলাদেশ এখনও একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। পক্ষপাত, জবাবদিহির অভাব এবং সংবিধানের বাস্তব প্রয়োগ না থাকাই এর প্রধান কারণ।

গণতন্ত্র তখনই বাঁচে, যখন রাষ্ট্র সকল মত, পথ ও দলকে সমান চোখে দেখে। পক্ষপাত, প্রশাসনিক পক্ষধারণ ও গোপন সুবিধা প্রদান গণতন্ত্রের গোড়ায় কুঠারাঘাত। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, বিচার বিভাগ—সবার উচিত আজই সজাগ হওয়া। নচেৎ সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়ানক ছায়া—যা গণতন্ত্রের নাম নিয়ে একনায়কতন্ত্রের কুশপুতুল হয়ে উঠতে পারে। সেই ছায়ার পেছনে যদি রাষ্ট্রযন্ত্রই থাকে, তবে একদিন জনগণই তার প্রতিশোধ নেবে—নির্বাচনের মাঠ নয়, ইতিহাসের রায়েই।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কিছু সুপারিশ সামনে আনা যায়, অনিবন্ধিত দলগুলোর কর্মকাণ্ডের ওপর নির্বাচন কমিশনের নজরদারি বাড়ানো, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রশাসনের সমতা বজায় রাখা, পক্ষপাতমূলক আচরণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায় নির্ধারণ, জনগণের করের টাকার ব্যবহার নিয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে আরও সোচ্চার হওয়া। এমনই কিছু পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আমরা ফিরে পেতে পারি একটি সুশাসনভিত্তিক প্রকৃত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ সাংবাদিক ও কলামিস্ট, দ্য ডেইলি অবজারভার


LATEST NEWS
MOST READ
Also read
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000.
Phone: PABX- 41053001-06; Online: 41053014; Advertisement: 41053012.
E-mail: [email protected], news©dailyobserverbd.com, advertisement©dailyobserverbd.com, For Online Edition: mailobserverbd©gmail.com
🔝
close