নিখিল চন্দ্র। তিস্তার গা ঘেষে বেড়ে ওঠা কুড়িগ্রামের হোকডাঙ্গা মাঝিপাড়ার মধ্যবয়সী এক পোড় খাওয়া জেলে। শৈশব-কৈশোর থেকে জীবনের বৈতরণী পার করেছেন তিস্তার বুকে মাছ ধরে। পেশা হিসেবে বেঁছে নিয়েছিলেন জেলে জীবন। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে আর কটা আটপৌঁঢ়ে জীবনের মতো চলছিল তাদের জীবন গাঁথা। তিস্তার বুকে নিজের ডিঙ্গি নৌকা ও জাল দিয়ে মাছ ধরতো রোজ। একসময় এই জেলেরও ছিল সুখের সাতকাহন। তবে মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে আজ তার পুঁজিহীন, সহায় সম্বলহীন ও ঋণে জর্জরিত জীবন।
জানা যায়, নিখিলের একমাত্র মেয়ে স্মৃতিরানী। এক বছর আগে তার বিয়ে ঠিক হয় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের কুমারগাড়িতে রতন দাসের সাথে। হিন্দু রীতি অনুযায়ী একমাত্র মেয়ে স্মৃতিরানীর বিয়েতে দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা পণ দেন নিখিল। আরও কথা ছিল মেয়ের হাতে ও কানে থাকবে সোনার গহনা। তবে নিজের একমাত্র সম্বল সেই প্রিয় ডিঙ্গি নৌকা ও জাল বিক্রি করার পরও এনজিও থেকে ঋণ করেন এক লাখ টাকা। এছাড়াও, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ঋণ করেছেন আরও লাখ খানেক টাকা। ভেবেছিলেন নিজের স্বপ্ন বেঁচে মেয়ের সুখ কিনবেন। কিন্তু সে গুঁড়েও বালি।
স্মৃতিরানীর বিয়ে হয়ে গেলেও ছয় মাস ধরে রয়েছেন বাপের বাড়িতে। অপরাধ এখনও গহনা দেননি বাবা নিখিল চন্দ্র। শ্বশুড় বাড়ির লোকেরাও রাখেন না খবর। এমনকি খবর নেন না স্বামী রতন দাস। হঠাৎ করে দরজায় ডাক পড়লেই স্মৃতি দৌঁড়ে যায় দরজার কাছে, শ্বশুড় বাড়ির কেউ এলো কি না জানতে। তবে ছয় মাসে ধীরে ধীরে ভাটা পড়ছে আশায়।
স্মৃতি ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'বিয়্যার পর তো ভালোয় চলছিল সংসার। তারপর শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির বুদ্ধি ধরি ধেরে ধেরে মোর ভাতারও পাল্টি গেইচে। পরে তায়ও বাড়ি থাকি গয়না নিয়া যাবার জন্যে মারধর করছে। একদিন তো বাড়িত থুয়া গেল, আর নিয়া না যায়। কইছে গয়না ছাড়া নিয়া যাবান্নয়।'
মেয়ের দিকে তাকালে বুক ফেটে যায় জানিয়ে নিখিল ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'যে নৌকাত মাছ ধরি ব্যাচে পেট চলছিল সে নৌকায় বেটির বিয়াও দিবার সময় বেচে ফেলাচি। এনজিওর ঋণ, মাইনষে টাকা পাইবে সেই চিন্তায় রাইতোত ঘুম আইসে না। তারপরে ফির জামাই বাড়িত বেটিক থুয়া গেইছে গয়নার জনতে। মাইনষের জমিত এ্যালা কামলা খাটি খাই। এত টাকা কোনটে পামো? তারপরও কামলা খাটি হইলেও বেটির গয়না বানে দেয়া নাগবে।'
শুধু নিখিল-স্মৃতির গল্প নয়, তিস্তা পারের হাজারও জেলের রয়েছে এমন হা-হুতাশের গল্প। রংপুর বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, রংপুর জেলায় ১২ হাজার ৬০৫ জন, গাইবান্ধায় ১৮ হাজার ৫৩৪ জন, কুড়িগ্রামে ১৮ হাজার ৬৯৬ জন, লালমনিরহাটে ৭ হাজার ৩৬০ জন, নীলফামারীতে ৭ হাজার ১৩ জন, দিনাজপুরে ১২ হাজার ৯৩ জন, পঞ্চগড়ে ৬ হাজার ৩৩৩ জন, ঠাকুরগাঁয়ে ৮ হাজার ৬৫৬ জন জেলে বসবাস করে। জেলেদের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ হলেও ধীরে ধীরে বেশির ভাগ জেলেই পাল্টাচ্ছেন তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা।
রংপুর অঞ্চলে সরকারি তালিকা মতে ২৫২টি নদী রয়েছে। তবে নদী ও পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলসের মতে, বাস্তবে এর সংখ্যা ৩০০ এরও উপরে। অর্ধ শতাব্দীতে নদী শাসন, নদী দখল ও নগরায়নের প্রভাবে হারিয়ে গেছে ৫০টিরও বেশি নদী। এছাড়া বিভিন্ন জেলায় একের পর এক বিল দখল হয়ে গড়ে উঠেছে জনবসতি।
ফলে একদিকে যেমন প্রকৃতির ভারসাম্য হারাচ্ছে অন্যদিকে এর প্রভাব পড়ছে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জীবিকায়। নদী-নালা ,খাল-বিল হারিয়ে জেলেদের জীবন ও জীবিকা এখন বিপন্নের দাঁড়প্রান্তে।
কুড়িগ্রাম রাজারহাটের হাড়িডাঙ্গা মাঝিপাড়া মেকুতটারীর গণেশ দাস বর্তমানে কাজ করেন ঢাকার একটি ব্যাগের কারখানায়।
গণেশের বাবা স্বপন দাশ ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'আগের মতো নদীতে আর মাছ পাওয়া যায় না। ভরা মৌসুমে বিভিন্ন রকমের মাছ পাওয়া গেলেও অন্যান্য সময়ে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। আগে তিস্তার বৈরালি মাছ জনপ্রিয় ছিল। এখন দেশি মাছ তেমন পাওয়া যায় না। আমার ছেলেটা তাই ঢাকায় ব্যাগের কারখানায় চাকরি করে। মাসে মাসে ৫ হাজার করে টাকা পাঠায়। এটা দিয়েই সংসারের উপকার হচ্ছে।'
২০০৯ সালে প্রণীত জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিতে বলা হয়, ‘জাল যার জলা তার’। এছাড়াও বলা হয় যিনি প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ শিকার এবং বিক্রয় করেই প্রধানত জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি প্রকৃত মৎস্যজীবী বলে গণ্য হবেন এবং নির্দিষ্ট জল মহালের নিকটবর্তী ও তীরবর্তী প্রকৃত মৎস্যজীবীদের সমিতি যা সমবায় অধিদপ্তরে নিবন্ধিত, যে সমিতি বা সমিতিসমূহ নির্দিষ্ট ও তীরবর্তী জলমহাল ব্যবস্থাপনার জন্য আবেদন করতে পারবেন। কোনো ব্যক্তি বা অনিবন্ধিত সংগঠন আবেদন করতে পারবে না।
আর এখানেই বেশির ভাগ জেলে নিয়মের ফাঁকিতে সংগঠনের সদস্য হতে পারছেন না। কিংবা তাদের অনেকেই জানে না কিভাবে মৎস্য সমবায় সমিতি গঠন করতে হয়। ফলে জলমহাল ব্যবস্থাপনায় জেলেদের কপালে লেখা হচ্ছে- ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’।
বর্তমানে বিভিন্ন জেলায় সরকারি জলমহাল থাকলেও সেগুলো এখন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের দখলে। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন থেকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে লীজ নিয়ে সেখানে ব্যবসায়ীরা মাছ চাষ করলেও সেখানে ঠাঁই পাননা জেলেরা।
রংপুরের পীরগাছার মাষাণকুড়া এলাকার বাবর নামের এক জেলে ডেইলি অবজারভারকে বলেন, ‘জলমহল এ্যালা ব্যবসায়ীর হাতে বন্দি। হামরা চাইলে লীজ নিবার পাবার নই। এই জন্যে ভরা মৌসুমে নদী-নালা ও অন্যান্য সময় মাইনষের পুকুরত মাছ মারি প্যাটের ভাত জোগাড় করি।'
একই গ্রামের মিনতি রানী বলেন, 'সরকার নাকি এত ঋণ দেয়। হামরা ঋণ কোনটে পাওয়া যায় সেটায় জানিনা। সরকার এত ব্যাংক খুলি থুইছে কিন্তু হামাক লোন দেয়না। লোন দেয় এনজিও। হামরা যদি এনজিওর টাকা শোধ করবার পাই তাইলে ব্যাংকের লোন শোধ করবার পাবার নই? হামার অসুখ বিসুখ হইলে কায়ো দেখার নাই।'
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের মাষানকুড়া, মাঝিপাড়া এলাকা, ছাওলা ইউনিয়নের বুড়াইল, রহমতের চর, চর তাম্বুলপুর, গংগাচড়া উপজেলার দক্ষিণ কোলকোন্দ ইউনিয়নের গোডাউনের হাট এলাকা ঘুরে রংপুরের জেলেদের জীবনাচরণ প্রত্যক্ষ করা গেছে। দিনে দিনে এই পেশা পাল্টে অনেকেই কাজ করছেন ক্ষেতে খামারে। আবার অনেকে নিজ এলাকা থেকে ঢাকায় বিভিন্ন কল কারখানা ও গার্মেন্টসে জীবিকার তাগিদে চাকরি করছেন।
আধুনিকতার ছোঁয়া অন্যান্য পেশায় লাগলেও জেলে পেশাতে লাগেনি বলে দাবি করেছেন তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও আন্দোলন পরিষদের অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী। তিনি ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'অন্যান্য দেশে জেলেদের নানা রকম প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। শুকনো মৌসুমে নদীর পানি কমে আসে। সেই কম পানিতে ভালো ভাবে সংরক্ষণ করেও স্বল্প সময়ের জন্য মাছ চাষ সম্ভব। এতে জেলেরা লাভবান হবে। অথচ এ দেশে কৃষকরা সনাতন পদ্ধতিতে মাছ চাষ করছেন এখনও।'
সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা অসদুপায় অবলম্বন করে সরকারি সম্পদ ব্যক্তিগত মালিকানাধীন করে দিচ্ছে। এতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ যেমন বেহাত হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে জীবিকার উপরেও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।
রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'সরকারের যারা এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেন তারা ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। ফলে যাচাই-বাছাই করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়না। আবার বলতে পারেন তারা চেষ্টাও করেনা। সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিৎ এই মন্ত্রণালয়কে আলাদা করে দেয়া। তাহলেই নদী রক্ষা পাবে, পরিবেশ রক্ষা পাবে, জীবিকা বিপর্যস্ত হবে না।'
রংপুর বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক আয়নাল হক ডেইলি অবজারভারকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সব জেলে সমান সুযোগ পায় না। উপকূলীয় অঞ্চল ও হাওর অঞ্চলের জেলে এবং উত্তরাঞ্চলে জেলেদের মধ্যে সুবিধার তারতম্য রয়েছে। রংপুর বিভাগের মৎস্যজীবীদের ক্ষেত্রে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ মৌসুমে সারা বাংলাদেশের জেলেদের ন্যায় রংপুর বিভাগের জেলেরাও ৪০ কেজি করে চাল পাচ্ছে। এছাড়াও তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।'
এমএ