কয়েক দফা নীতিমালা প্রণয়ন, প্রচারণা ও জরিমানার পরও সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে হাউসবোটের বেপরোয়া চলাচল ও পর্যটকদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন।
পর্যটকবাহী হাউসবোটগুলো নির্ধারিত নৌপথ অনুসরণ না করে হাওরের মাঝ দিয়ে চলাচল করায় হুমকির মুখে পড়েছে হাওরের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র, জলজ উদ্ভিদ এবং স্থানীয় কৃষিজমি।
এছাড়া, স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা উপেক্ষা করেই বিলাসবহুল হাউসবোটে পর্যটকদের মদ্যপান ও অশ্লীলতায় লিপ্ত হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এর ফলে হাওর জনপদের চিরায়ত সংস্কৃতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
তাই শুধুমাত্র নীতিমালা প্রণয়ন ও মাঝে মাঝে মনিটরিং নয়, হাউসবোটের বেপরোয়া দৌরাত্ম্য এবং পর্যটকদের অশালীন আচরণ রোধে প্রশাসনকে আরও কার্যকর ও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে—এমন দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন হাওর তীরবর্তী জনপদের বাসিন্দারা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বড় আকারের প্রপেলারের কারণে হাউসবোটগুলো ঝাউ বনসহ অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ ধ্বংস করছে। মাছ ও পাখির আবাসস্থলও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি, অনেক পর্যটক মাদক সেবন ও নানা অশ্লীল কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ায় তা স্থানীয় জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সম্প্রতি একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যায় এক নারী মদের বোতল হাতে নিয়ে নাচছেন, রিল বানাচ্ছেন এবং পানিতে ভিজে উন্মাদনায় মেতেছেন। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ভিডিওতে দেখা যায়, এক নারী ডিঙি নৌকায় বসে প্রকাশ্যে মদ্যপান করছেন এবং তা রেকর্ড করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
তারা বলছেন, এ ধরনের পর্যটন টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
‘টাঙ্গুয়ার হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক বাদল চন্দ্র সরকার বলেন, “হাউসবোটে মদের আসর নতুন কিছু নয়। পানি শুকিয়ে গেলে হাওরের তলদেশ প্লাস্টিক ও মদের বোতলে ঢেকে যায়, ফলে কৃষিকাজ হুমকির মুখে পড়ে।”
তিনি আরও বলেন, “হাউসবোটে পর্যটকদের তালিকা রাখা বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়। হাউসবোটের বেপরোয়া চলাচল এবং মাদক ও অশ্লীলতার লাগাম টানতে প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
টাঙ্গুয়ার হাওরে হাউসবোট জলযাত্রা-এর ক্যাপ্টেন মো. রনি শেখ বলেন, “সুন্দরবনে আমি প্রায় ২০ বছর পর্যটন খাতে কাজ করেছি। ওখানে যেভাবে নীতিমালা মানা হয়, টাঙ্গুয়ার হাওরে তেমনটি দেখি না। হাওরে ময়লা-আবর্জনা ও প্লাস্টিক ভাসতে দেখা যায়—যা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বন্ধ হচ্ছে না। ফলে হাওরের মাছ ও পাখি কমে যাচ্ছে, এবং পানির নিচের পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে।”
তবে তিনি দাবি করেন, তার পরিচালিত হাউসবোটে কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয় না।
মধ্যনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজ্জ্বল রায় বলেন, “টাঙ্গুয়ার হাওরে হাউসবোটের জন্য নির্ধারিত রুটে চলাচলের নির্দেশনা রয়েছে। পর্যটকদের জন্য রয়েছে আচরণবিধিও। যারা এসব নির্দেশনা অমান্য করবেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে।
টাঙ্গুয়ার হাওর একটি আন্তর্জাতিক সম্পদ। এর পরিবেশ ও সুনাম রক্ষায় আমরা সতর্ক ও কঠোর অবস্থানে রয়েছি। বিশেষ করে, হাউসবোটে পর্যটকদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে, সংশ্লিষ্ট বোট ও ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।”
আরএ/আরএন