সরকারঘনিষ্ঠ একজন উপদেষ্টা সরকারি সফরে বিদেশ যাচ্ছেন। লাগেজ স্ক্যানিংয়ের সময় নিরাপত্তা কর্মীরা হঠাৎ থমকে দাঁড়ান—উপদেষ্টার ব্যাগে পাওয়া যায় গুলিভর্তি একটি ম্যাগাজিন। কোনো অনুমতিপত্র নেই, আগাম কোনো ঘোষণা নেই, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও এ বিষয়ে জানা নেই। ঘটনা মিডিয়ায় আলোড়ন তোলে, কিন্তু প্রশাসনিক বা আইনগত কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয় না। কিছুদিন পর সবকিছু থিতিয়ে পড়ে—নিশ্চুপ, নির্বিকার।
প্রশ্ন ওঠে: কীভাবে একজন রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গুলি নিয়ে প্রবেশ করেন? এটি কি নিছক ভুল, না কি ইচ্ছাকৃত পদক্ষেপ? এটি কি নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা, না কি ক্ষমতার দাপটে আইনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া? এই একটি ঘটনা রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে থাকা গভীর ফাটলকে নগ্ন করে দেয়—যেখানে নিয়মের ছিদ্রপথে গুলি ঢুকে পড়ে রাষ্ট্রনৈতিক নৈতিকতার হৃদয়কেন্দ্রে।
ক্ষমতার প্রতীক যখন বন্দুক: একটি বন্দুক কেবল ধাতব বস্তু নয়। এটি প্রতীক—প্রতাপের, ভয়ের, কর্তৃত্বের। যখন একজন রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টার ব্যাগে গুলি পাওয়া যায়, তখন এটি ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয় থাকে না; বরং হয়ে ওঠে এক প্রকার রাজনৈতিক বার্তা। উপদেষ্টারা রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির দায়িত্বে থাকেন। তারা কথা বলার জন্য নিয়োজিত—গুলি ছোড়ার জন্য নয়। তাই এমন ঘটনার পর যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন জাগে—এই উপদেষ্টা কি সংলাপের জন্য প্রস্তুত, না কি সংঘাতের?
অধ্যাপক তানিয়া হক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, “রাষ্ট্রযন্ত্র যখন নিরব থাকে, মানুষ তখন নিজেই ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। এ ধরনের ঘটনার পর তদন্ত না হলে জনমানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়, এবং তারা ভাবতে থাকে রাষ্ট্র আসলে কার জন্য। রাষ্ট্র যদি অস্ত্রের কাছে নত হয়, তবে গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়।”
আইন যা বলে—আর রাষ্ট্র যা করে: ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন ও ২০১৮ সালের সংশোধিত আগ্নেয়াস্ত্র বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি—তিনি সরকারী কর্মকর্তা হোন বা বেসরকারি—প্রয়োজনীয় অনুমতি ও বৈধ কাগজপত্র ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র বা গুলি বহন করতে পারেন না। বিমানবন্দর কেবল একটি পাবলিক স্পেস নয়—এটি দেশের অন্যতম উচ্চস্তরের নিরাপত্তা এলাকা। সেখানে গুলি পাওয়া যাওয়া—সেটি বৈধ হোক বা অবৈধ—একটি গুরুতর নিরাপত্তা লঙ্ঘন। আইন অনুযায়ী, এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন, মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী বলেন, “এই ঘটনা আইনভঙ্গের স্পষ্ট উদাহরণ হলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অনুপস্থিতি আমাদের আইনি কাঠামো ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অসুস্থতা প্রকাশ করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন দায়মুক্তি চলতে পারে না।”
‘ভুল’ নয়—দায়িত্বহীনতার নামান্তর: কিছু মানুষ বলছে, “এটি ছিল অনিচাকৃত ভুল।” কিন্তু বাস্তবতা হলো—চিপস বা কলম ভুলক্রমে ব্যাগে থাকতে পারে, কিন্তু গুলি নয়। একজন সিনিয়র সরকারি উপদেষ্টার এমন “ভুল” প্রশ্ন তোলে তার দায়িত্ববোধ, প্রজ্ঞা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে।
অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, আইন অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, “কোনো ভিআইপি হোক বা সরকারি কর্মকর্তা—অস্ত্র বা গুলি বহনের ক্ষেত্রে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি, ভিআইপিদের জন্য যেন এক অলিখিত ‘আইনের ঊর্ধ্বে’ সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।”
যদি ভিআইপিদের জন্য নিরাপত্তা প্রটোকল শিথিল হয়, তবে জনগণের নিরাপত্তা কোথায় দাঁড়াবে? সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ কী পদক্ষেপ নিয়েছে? তদন্ত কোথায়? জবাবদিহি কে করবে? এই প্রশ্নগুলো হারিয়ে যায় প্রশাসনিক নীরবতার গহ্বরে।
আন্তর্জাতিক তুলনা: অন্য দেশে কী হতো? ধরে নেওয়া যাক ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রে ঘটেছে—তখন TSA সঙ্গে সঙ্গে উপদেষ্টাকে আটক করত, FBI তদন্ত শুরু করত। যুক্তরাজ্যে এমন ব্যক্তি মুহূর্তেই পদত্যাগে বাধ্য হতেন। জার্মানিতে তদন্ত শুরু হতো জনরোষ ওঠার আগেই।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, “আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি—তিনি যত উচ্চপদস্থই হোন না কেন—নিরাপত্তা অঞ্চলে গুলি বহনের ক্ষেত্রে তদন্ত ও ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটার পরও কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা না হওয়া আমাদের নিরাপত্তা সংস্কৃতির দুর্বলতাকে তুলে ধরে।”
বাংলাদেশে? কেবল একটি বিবৃতি: "ভুল হয়েছে।" এর বেশি কিছু নয়। এই ভিআইপি অস্ত্র-সংস্কৃতি নতুন নয়। পাকিস্তান, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া এমনকি ভারতের কিছু রাজ্যেও দেখা যায়, ক্ষমতা আইন দিয়ে নয়—দেহরক্ষী, গাড়ির কনভয়, এবং দৃশ্যমান অস্ত্রের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
প্রস্তাবনা ও করণীয়: একটি স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত অবিলম্বে শুরু করতে হবে। উপদেষ্টাকে সাময়িকভাবে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। ভিআইপি নিরাপত্তা ছাড় সংস্কৃতি বাতিল করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের অস্ত্র বহন সংক্রান্ত নীতিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। গণমাধ্যমকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে।
ন্যায়বিচার না হলে রাষ্ট্র অস্ত্রের ভয়েই দাঁড়ায়: রাষ্ট্র যখন বন্দুক হাতে কাউকে রক্ষা করে, তখন জনগণ নিরাপত্তা নয়—ভয় পায়। কিন্তু যখন রাষ্ট্র আইন ও ন্যায়ের ভিত্তিতে চলে, তখনই জনগণ আস্থা ফিরে পায়।
এই ঘটনা হয়তো ছোট, কিন্তু এর প্রতীকী ও নৈতিক ওজন গভীর। এটি দেখায় রাষ্ট্র কাদের রক্ষা করে, কে জবাবদিহি এড়ায়, আর কার জীবনের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আমরা যদি সত্যিই ন্যায়ের ভিত্তিতে দাঁড়ানো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই, তবে এই ঘটনাকে “ভুল” বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া নয়—বরং এটি হতে হবে সংস্কারের উপলক্ষ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রোজী মোজাম্মেল মহিলা অনার্স কলেজ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট