লালমনিরহাটে গত কয়েকদিনের বন্যার পর পানি নেমে গিয়ে এখন ভেসে উঠতে শুরু করেছে ক্ষত। ফলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দুর্ভোগ বেড়েছে তিস্তাপাড়ে। রোপা আমন খেত পঁচে গলে নষ্ট হওয়ায় কপালে দুঃচিন্তার ভাঁজ পড়েছে দুর্গত এলাকার কৃষকদের কপালে।
কয়েক দফায় ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢল ও গত কয়েকদিনের টানা ভারি বৃষ্টিতে হু হু করে বাড়ে তিস্তা নদীর পানি। গত সোমবার রাতে ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বিপদসীমা অতিক্রম করে। মঙ্গলবার সকাল থেকে বন্যায় প্লাবিত হয় তিস্তা নদীর বাম তীরের জেলা লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার অধিকাংশ এলাকা। টানা তিন দিনের বন্যায় ডুবে যায় নদী তীরবর্তি ও চরাঞ্চলের ফসলি খেত। পানিবন্দি হয়ে পড়ে জেলার অন্তত ৩০ হাজার পরিবার। একই সাথে পানি তোরে ভেসে গেছে মৎস্য চাষিদের পুকুরের মাছ। বিশেষ করে আমন খেত ও বীজতলা ডুবে যাওয়ায় কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে তিস্তা পাড়ের নিম্নাঞ্চলে। শুক্রবার পানি কমতে শুরু করলে জেগে উঠতে থাকে বন্যার ক্ষত।
দফায় দফায় বন্যার কবলে পড়ে আমনের লাগানো চারা বন্যার পানিতে পঁচে গলে নষ্ট হয়েছে। অধিকাংশ খেতে শুধু মাটি বালু পড়ে রয়েছে, নেই কোন আমনের চারা। কিছু খেতে চারা গাছ দেখা গেলেও শুক্রবারের প্রচন্ড রোদে তা গলে পঁচে নষ্ট হচ্ছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে দ্বিতীয় দফার বন্যায় নষ্ট হওয়া আমন খেতে নতুন করে চারা লাগান নদী পাড়ের কৃষকরা। সেটাও তৃতীয় দফার বন্যায় ৩/৪ দিন ডুবে থেকে নষ্ট হয়েছে। নতুন করে লাগানোর মত চারা নেই অধিকাংশ চাষির। ফলে আমন নিয়ে দুঃচিন্তার ভাঁজ পড়েছে তিস্তাপাড়ের চাষিদের কপালে।
এদিকে টানা তিন/চার দিন পর বাড়ি ঘর থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও দুর্ভোগ কমেনি নদীপাড়ে। পানির তোড়ে নষ্ট হওয়া ঘর বাড়ি বেড়া মেরামত করছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। বন্যার পানির সাথে ভেসে আসা ময়লা আবর্জনার স্তুপ ডুকে পড়েছে বাড়িতে বাড়িতে। ঝোপ ঝাড়ে আশ্রয় নিয়েছে সাপ পোকামাকড়। বন্যার সময় আধো খাওয়া পেটে কেউবা খেয়ে না খেয়ে দিন পার করা মানুষগুলো ক্লান্ত শরীর নিয়ে এসব সংস্কার করতে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। পানিবন্দি পরিবারগুলোর বন্যার পানিতে অনেকের গুরুত্বপূর্ণ জিনিস পত্র ভিজে নষ্ট হয়েছে। আবার বন্যার পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে নদীপাড়ের বেশ কিছু বিদ্যালয়ের মাঠ, পাঠদান কক্ষ আর আসবাবপত্র।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর জানিয়েছে, তৃতীয় দফার বন্যায় জেলার ৯১৫ হেক্টর জমির আমন খেতে ও ৬৩ হেক্টর জমির অন্যান্য ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। যার সামান্য কিছু নষ্ট হলেও নতুন করে রোপন করার সময় রয়েছে।
যদিও কৃষি বিভাগের এ তথ্য মানতে নারাজ স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা। তাদের মতে, শুধু নদী পাড়ে বন্যায় ফসল খেত ডুবেনি। টানা ভারি বৃষ্টিতে সারা জেলার নিম্নাঞ্চলের খেত ডুবেছে। পানিতে তলিয়ে আছে ৪-৫ দিন ধরে। ফলে কৃষিতে ক্ষতির পরিমান অনেক বেশি বলে দাবি এখানকার চাষিদের।
সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নের কৃষক শহীদ মিয়া বলেন, কয়েকদিন আগে একবার বন্যায় ডুবে গিয়ে আমার আড়াই বিঘা জমির আমন ধান নষ্ট হয়েছিল। অনেক কষ্টে চারা সংগ্রহ করে দ্বিতীয় দফায় রোপন করেছিলাম। সেটাও এক সপ্তাহের ব্যবধানের বন্যার পানিতে ডুবে নষ্ট হলো। এখন আবার চারা কিনব কিভাবে জানিনা। পরিবারের জন্য কি খাবার ফলাবো তাও জানিনা।
আদিতমারী উপজেলার চর গোরধনের বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, “বন্যা আমাদের সর্বনাশ করে দিয়েছে। এমনিতেই এখন চাষাবাদে অনেক খরচ। তার ওপর বারবার বন্যা। চাষাবাদ করে আমরা লাভের মুখ দেখতে পারি না। যা আবাদ করি, ঠিকমতো তার দাম পাই না। কিন্তু এবারের বন্যায় আমাদের সবকিছু শেষ করে দিলো। সামনে দিনগুলো কেমন যাবে, আমরা কিভাবে বাঁচবো, সেটা কেউই জানি না।
হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, এবারের বন্যায় কৃষকের ক্ষতি হয়েছে পাশাপাশি নদী ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে অনেক মানুষ গত এক সপ্তাহে অন্তত ২০ বিঘা জমি নদীগর্ভে চলে গেছে ঝুঁকিতে রয়েছে আরো অনেক আবাদি জমি।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড. সাইখুল আরিফিন জানান, বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় আমন খেত সামান্য কিছু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে নদীপাড়ের চাষিরা বন্যা কালিন আপদের জন্য উচু এলাকায় আমনের বলান করে রাখেন। পানি নেমে গেছে নষ্ট হওয়া খেতে সেই আমনের বলান করা চারা রোপন করতে চাষিদের প্রতি পরামর্শ তাঁর। আমনের চারা রোপনের এখনও সময় রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড লালমনিরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার জানান, নদীর পানি কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও নদীতে ভাঙনের শঙ্কা আছে। সেদিক থেকে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে নদীপাড়ে।
এসআর