প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে কার্প জাতীয় মা মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) ডিম ছেড়েছে। গত সোমবার ও মঙ্গলবার কার্পজাতীয় মা মাছ নদীতে নমুনা ডিম ছেড়েছে। বুধবার বজ্রসহ প্রবল বর্ষণের কারণে নদীতে ঢলের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দুইটা থেকে কার্পজাতীয় মা মাছ আমতুয়া নাপিতের ঘাট এলাকায় ডিম ছাড়তে শুরু করে। যে পরিমাণ ডিম ছেড়েছে, তা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এতে ডিম আহরণকারীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
এবার নদীতে প্রায় ৪ থেকে ৫ শতাধিক নৌকা, প্রয়োজনীয় লোকবল ও ডিম সংগ্রহের সরঞ্জাম নিয়ে ডিম আহরণকারীরা প্রতিটি নৌকায় ৫ থেকে ৬ বালতি করে ডিম সংগ্রহ করেছেন বলে তারা জানান।
ডিম আহরণকারী ও দায়িত্বশীলদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাংলা ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি সময় কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, চংখালী, সানাইখাল, কুমারখালী, বোয়ালিয়া, সর্ত্তাখালসহ বিভিন্ন নদী, খাল ও ছরা থেকে মা মাছ হালদা নদীতে এসে ডিম ছাড়ে। পরিবেশ অনুকূল থাকলে চৈত্র ও বৈশাখ মাসের আমাবস্যা, অষ্টমী ও পূর্ণিমা তিথিতে কার্পজাতীয় মা মাছ হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে। এবার বাংলা বছরের চৈত্র ও বৈশাখ মাসে বৃষ্টি হয়নি। জৈষ্ঠ্যের ১৩ তারিখ থেকে বজ্রসহ প্রবল বর্ষণের ফলে নদীতে ঢলের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় মা মাছ নদীতে ডিম ছেড়তে শুরু করে।
হালদা নদীর আমতুয়া, আজিমারঘাট, নাপিতরঘাট, কুমারখালী, বাড়িয়াঘানা, রামদাশ মুন্সিরহাট, গড়দুয়ারা, নয়াহাট, ছিপাহীরঘাট, কাগতিয়ারচর, পাতাইজ্জারটক, মাছুয়াঘানা স্লুইস গেইট, পোড়াকপালীর মুখ, আজিমারঘাট, আমতুয়া, কুমারখালী, বাড়িয়াঘানা, মাদার্শা বড়ুয়াপাড়া, মাদারী স্লুইস গেইট প্রভৃতি এলাকায় কার্পজাতীয় মা মাছ নদীতে ডিম ছাড়ে। এদিকে, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার সরকারি হ্যাচারীতে ডিম থেকে পোনা ফোটানোর জন্য ডিম সংগ্রাহকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নদী থেকে ২০১৪ সালে ১৩ মে ৩৬৪টি নৌকা থেকে ১৬,৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়। ২০১৫ সালে ২১ এপ্রিল ২৭৫টি নৌকা থেকে ২,৮০০ কেজি ডিম সংগ্রহ হয়। ২০১৬ সালে ২০ মে ২৪৫টি নৌকা থেকে ৭৩৫ কেজি, ২০১৭ সালে ২২ এপ্রিল ১০৫টি নৌকা থেকে ১,৬৮০ কেজি, ২০১৮ সালে ২০ এপ্রিল ৪০৫টি নৌকা থেকে ২২,৬৮০ কেজি, ২০১৯ সালে ২৫ মে ২৩০টি নৌকা থেকে ৬,৯৮৫.৭ কেজি, ২০২০ সালে ২৮০টি নৌকা থেকে প্রায় ২৫,৫৩৬ কেজি, ২০২১ সালে ২৮০টি নৌকা থেকে ৮,৫০০ কেজি, ২০২২ সালে ৩০০ নৌকা থেকে ৬,০০০ কেজি, ২০২৩ সালে ১৪,০০৬ কেজি, ২০২৪ সালে ১,৬৮০ কেজি, এবং ২০২৫ সালে ৪-৫ শত নৌকা ডিম সংগ্রহ করেছে। সংগৃহীত ডিমের হিসাব সংক্রান্ত কমিটি বৈঠক করেছেন বলে জানা গেছে।
ডিম আহরণকারী কামাল সওদাগর জানান, হালদা নদীতে গত সোমবার ও মঙ্গলবার নমুনা ডিম ছেড়েছে মা মাছ। অমাবস্যার পর বজ্রসহ প্রবল বর্ষণের কারণে নদীতে ঢলের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়ে বৃহস্পতিবার রাত দুইটার দিকে মা মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করলে মধ্যরাতে ব্যাপকভাবে ডিম ছেড়ে দেয়। এবার ডিমের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আহরণকারীরা খুব খুশি। আহরিত ডিম থেকে পোনা ও রেণু ফোটানোর কাজে তারা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ (সিসিপিসি) জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. শফিকুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার রাত দুইটার দিকে হালদা নদীর আমতুয়া নাপিতের ঘাট এলাকায় মা মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করে। রাতে নদীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম ছেড়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরীর সমন্বয়কারী, প্রাণীবিদ্যাবিভাগের সভাপতি ও হালদা গবেষক অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া জানান, নদীর বিভিন্ন অংশে প্রচুর পরিমাণ ডিম পাওয়া গেছে। জোয়ারের সময় নদীর উপরিভাগে ডিম ছেড়ে মা মাছরা প্রজনন কার্য সম্পাদন করছে। এখন হালদার পাড়ে বহুল প্রতীক্ষিত ডিম সংগ্রহের উৎসব চলছে। গত বছরের তুলনায় ডিমের পরিমাণ অনেক বেশি বলে তিনি জানান। ডিম আহরণকারীরা এই মুহূর্তে ডিম আহরণের ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম মশিউজ্জামান নদীতে মা মাছের ডিম ছেড়ার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় ডিমের পরিমাণ অনেক বেশি। মা মাছ ডিম ছাড়ার পর দুর্বল হয়ে পড়ায় যাতে মা মাছ শিকার করতে না পারে, তার জন্য প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ইউএন/আরএন