বাজারগুলোতে এখন লাল টসটসে লিচুর রঙে ভরে উঠেছে প্রতিটি আড়ত। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত লিচু বেচাকেনা চলে টানা। ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে বাজারের প্রতিটি কোণা। আড়তজুড়ে চলে হাকডাক, দর-কষাকষির সরগরম পরিবেশ। তবে এই উৎসবমুখর দৃশ্যের আড়ালে চাপা পড়ে আছে কৃষকদের অসন্তোষ। কারণ, ফলনের বিপরীতে দাম যেন তাদের কষ্টের মূল্য দিচ্ছে না। মাঠে লিচুর হাসি ফুটলেও চাষিদের মুখে সেই হাসি নেই। বাজারে লিচুর রঙ যতই টসটসে হোক, দাম নিয়ে তাদের মন ততটাই মলিন।
নাটোরের লিচু দেশের ভোক্তাদের কাছে একটি পরিচিত ও জনপ্রিয় ফল। সুস্বাদু ও আকর্ষণীয় এই ফলের মৌসুম এলেই জেলা জুড়ে জমে ওঠে লিচুর পাইকারি বাজার। বিশেষ করে গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়ন ও আশপাশের এলাকার আড়তগুলো হয়ে ওঠে সরগরম। তবে চলতি বছর লিচুর মৌসুমে আশার পাশাপাশি মিশে আছে হতাশার সুরও। কারণ এবার জেলার লিচু উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হলেও বাজারমূল্য কমে যাওয়ায় আর্থিক দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষিরা।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে জেলায় ৯২৪ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ৮৯৭ মেট্রিক টন। বাজারদর ধরে যার মোট আর্থিক মূল্য ধরা হচ্ছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি লিচু উৎপাদন হয়েছে গুরুদাসপুর উপজেলায়। এখানেই ৪১০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ৩ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন লিচু। যার বাজারমূল্য প্রায় ১৪০ কোটি ২২ লাখ টাকা।
এখানকার মোজাফ্ফর, বোম্বে ও চায়না-৩ জাতের লিচু দেশব্যাপী বেশ সমাদৃত। স্থানীয় নাজিরপুর, মোল্লা বাজার, ঝাউপাড়া, বেরগঙ্গারামপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে ২০ থেকে ২৫ টি মৌসুমি লিচুর আড়ত। এসব আড়ত থেকে প্রতিদিন ৫০-৫৫ লাখ টাকার লিচু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এই লিচুর হাট। মৌসুমে এসব আড়তে ২৫০-৩০০ জন শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
তবে গত বছরের তুলনায় লিচুর উৎপাদন বাড়লেও দাম অনেক কম। কৃষক ও আড়তদারদের ভাষ্যমতে, চলতি মৌসুমে প্রতি হাজার লিচুর পাইকারি দাম রকমভেদে ১,২০০ টাকা থেকে ১,৭০০ টাকা। যেখানে গত বছর দাম ছিল ২,২০০-২,৪০০ টাকা। এতে করে প্রতি হাজার লিচুতে গড়ে ৪০০-৫০০ টাকা কম পাচ্ছেন চাষিরা। কৃষকদের অভিযোগ, আকারে লিচু কিছুটা ছোট হওয়ায় এবং বাজারে সরবরাহ বেশি থাকায় দাম কমেছে। ফলে তাদের প্রত্যাশিত লাভের ঘরে বড় ধাক্কা লেগেছে।
ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, যশোর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে নাটোরের লিচুর কদর রয়েছে। সরেজমিনে গুরুদাসপুরের বেড়গঙ্গারামপুর বটতলা লিচুর মোকামে গিয়ে দেখা যায়, ফড়িয়ারা উন্মুক্ত নিলামে লিচু কিনছেন এবং শ্রমিকরা সেগুলো বিভিন্ন জেলায় পাঠানোর জন্য প্যাকেট করছেন। এ সময় কথা হয় কৃষক রাজিব হোসেন ও বেলাল হোসেনের সঙ্গে। তারা জানান, অনুকূল আবহাওয়ায় ফলন ভালো হলেও আকার ছোট হওয়ায় বাজারে দাম কম মিলছে। এতে তাদের লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।
আড়তদার আব্দুল মান্নান জানান, এবার উৎপাদন বেশি হলেও পাইকারদের আগ্রহ তুলনামূলক কম। অন্যদিকে নাজিরপুরের লিচু আড়ত কমিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও আড়তগুলোর ইজারা হয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কমিটির পাশাপাশি স্থানীয় থানা পুলিশও দায়িত্ব পালন করছে।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কৃষিবিদ ড. ইয়াছিন আলী বলেন, নাটোরের লিচু দেশের ফল বাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে উৎপাদন বাড়লেও দাম কমে যাওয়া এ অঞ্চলের চাষিদের জন্য এক ধরনের আর্থিক চাপ তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নাটোরের লিচুর চাহিদা থাকলেও বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং চাষিদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ বাড়ানো প্রয়োজন। একইসঙ্গে লিচুর প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ শিল্প গড়ে উঠলে কৃষকদের আয় বাড়বে এবং নাটোরের লিচু জাতীয় অর্থনীতিতেও আরও বড় অবদান রাখতে পারবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এমএম/আরএন