২২ দিনের ইলিশ শিকারের নিষেধাজ্ঞা শেষ হচ্ছে আজ (শনিবার) মধ্যরাতে। নিষেধাজ্ঞা শেষ হতেই উপকূলীয় জেলাগুলো থেকে ৫০ হাজারেরও বেশি জেলে সমুদ্রে পাড়ি জমাবেন ইলিশ আহরণের উদ্দেশ্যে। ঋণের বোঝা ও জলদস্যু আতঙ্ক মাথায় নিয়ে জেলেরা ইতিমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। জেলেদের নিরাপত্তায় বনবিভাগের পাশাপাশি কোস্টগার্ড ও র্যাব সমুদ্রে নজরদারি জোরদার করেছে।
ইলিশের প্রজনন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৎস্য বিভাগ গত ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এর আগে সরকার এই বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে ৫৮ দিনের জন্য ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছিল।
নিষেধাজ্ঞা চলাকালে মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
শনিবার দিনভর শরণখোলা, মংলা, দাকোপ, পাইকগাছা সহ উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জেলেদের ফিশিং নৌকায় জাল, বরফ, জ্বালানি ও অন্যান্য সরঞ্জাম বোঝাই করতে দেখা গেছে।
শরণখোলা উপজেলা ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মো. আবুল হোসেন জানান, নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় জেলেরা সমুদ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। শনিবার (২৫ অক্টোবর) মধ্যরাতেই ফিশিংবোটের বহর সাগরের উদ্দেশে রওনা হবে।
তিনি আরও বলেন, “ঋণের বোঝা ও জলদস্যুর আতঙ্ক নিয়ে জেলেরা এবার সমুদ্রে যাচ্ছেন। এবারের ইলিশ মৌসুমে নদী ও সাগরে পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যায়নি। বৈরী আবহাওয়ার কারণে কয়েক দফায় মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হয়েছে। ক্রমাগত লোকসানে পড়ে জেলে ও মহাজনরা ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন।”
তিনি জানান, “দীর্ঘ কয়েক বছর পর আবারও সাগর ও সুন্দরবনে জলদস্যুদের তৎপরতা বেড়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন জেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে জেলে-মহাজনদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।”
শরণখোলার রাজেশ্বর গ্রামের জেলে আব্দুস সোবহান, খোন্তাকাটা গ্রামের খালেক মুন্সি ও সাউথখালীর আব্দুল জলিলসহ অনেক জেলে বলেন, “গত ২২ দিন মাছ ধরতে না পেরে আমরা বেকার হয়ে পড়েছিলাম। মহাজন ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কোনোভাবে সংসার চালাতে হয়েছে।”
বরগুনা জেলা ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, “উপকূলের জেলেরা এবছর খুব কষ্টে আছেন। ইলিশ মৌসুমে প্রত্যাশিত মাছ না পেয়ে অধিকাংশ জেলে-মহাজন ঋণে জর্জরিত। নিষেধাজ্ঞা শেষে নতুন আশায় তারা সমুদ্রে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।”
এদিকে খুলনার ডুমুরিয়া থেকে ৬৫টি ফিশিং ট্রলার বহরে সমুদ্রে যাচ্ছেন ৬৬৫ জন জেলে। এ এলাকার অধিকাংশ জেলে মোংলা হয়ে সাগরে যাত্রা করবেন। বনবিভাগ দুবলার চর, আলোরকোল, মাঝের চর, শ্যালার চর ও নারিকেলবাড়ীয়া চরে তাদের অবস্থান নির্ধারণ করেছে।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সোহেল মো. জিল্লুর রহমান রিগান জানান, “ডুমুরিয়ার জেলেরা সরকারি নির্দেশনা মেনে ২২ দিন মাছ ধরা থেকে বিরত ছিলেন। এবার ৬৫টি আর্টিসানাল নৌযানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। নির্বিঘ্নে ও হয়রানি ছাড়া জেলেরা সমুদ্রে মাছ আহরণ করতে পারবেন। এ প্রথম ডুমুরিয়া থেকে নৌযানের অনুমতিপত্র নিয়ে জেলেরা সমুদ্রে যাচ্ছেন।”
মাছ ব্যবসায়ী আলী হোসেন জানান, “ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রেতারা ইতোমধ্যে পটুয়াখালী, বাগেরহাট ও বরগুনার মাছ অবতরণ কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছেছেন।”
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) রাজ কুমার বিশ্বাস বলেন, “এ বছর ইলিশ শিকারের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা আজ মধ্যরাতে তুলে নেওয়া হবে। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে অবৈধভাবে মাছ ধরার সময় প্রায় দুই লাখ মিটার জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা শেষে জেলেরা ভালো মাছ পাবেন বলে আমরা আশা করছি।”
সম্প্রতি সুন্দরবন সংলগ্ন সাগরে জলদস্যু ও বনদস্যুদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ বিষয়ে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “এবার প্রায় ৯০০ ফিশিংবোটকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। গত বছর এই সময়ে সমুদ্রে ডাকাতদের উপদ্রব বেশি ছিল। তাই নিরাপত্তার জন্য কোস্টগার্ডকে চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং র্যাবকেও সহযোগিতার জন্য মৌখিকভাবে অনুরোধ করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “জেলেদের নিরাপদে মাছ ধরতে বলা হয়েছে এবং গভীর সমুদ্রে কোনো নৌকা যেন একা না যায়, সে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।”
এসএস/আরএন