
সকালে হাওরের ভাঙাচোরা সড়ক পেরিয়ে যখন সেলবরষ উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনে দাঁড়ালাম, তখন দরজায় তালা বন্ধ, স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বারান্দার চারপাশে ময়লার স্তুপ, আর ভেতরে এক অস্বস্তিকর গন্ধ আমাকে থমকে দিল। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল অগোছালো কয়েকটা বস্তা—ভর্তি কেবল মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। পাশে কার্টুনভর্তি ফেলে রাখা সিরাপের বোতল, যেগুলো একসময় হয়তো অসুস্থ শিশুর জীবন বাঁচাতে পারত।
ওষুধ আছে, চিকিৎসা নেই
সরকারি নথি বলছে, এখানে একজন এমবিবিএস ডাক্তার থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো—চিকিৎসক নেই, নেই কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। একজন মিডওয়াইফ আর এক ঝাড়ুদারের ওপর ভর করে চলছে ‘চিকিৎসা’। সপ্তাহে সাত দিন খোলা থাকার নিয়ম থাকলেও দরজা খোলে মাত্র এক-দুই দিন দুই ঘণ্টার জন্য। হাওরের প্রায় ৭০ হাজার মানুষের জন্য এ স্বাস্থ্য কেন্দ্রই প্রাথমিক চিকিৎসার একমাত্র আশ্রয়, অথচ সেটিই আজ অচল।
রোগীদের কান্না
কেন্দ্রের সামনে দেখা হলো মাঝবয়সী রশিদা বেগমের সঙ্গে। চোখ ভরা আক্ষেপ নিয়ে বললেন, “ওষুধ নিতে আই, বলে নাই। জ্বরের ঔষধ দিলে গ্যাসের ঔষধ দেয় না। আবার দেহি বস্তায় ভরা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। তাইলে আমরা যাইয়াম কই? কেউর অসুখ হইলে ভাঙ্গা রাস্তা পার হইয়া ৪ মাইল দুরা যাইতে অয়।”
এমন অভিযোগ শুধু রশিদার নয়, গ্রামের অনেকেই একই কণ্ঠে বললেন—ওষুধ বরাদ্দ থাকলেও তা রোগীদের হাতে পৌঁছায় না। পরে সেগুলো ধীরে ধীরে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়।
ভেতরের চিত্র
কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেল—প্যারাসিটামল, সালভিটমল, এজিথ্রোমাইসিন সিরাপের মতো জীবনরক্ষাকারী ওষুধের মেয়াদ অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। কিছু বোতল ধুলায় ঢাকা, কিছু ভাঙা কার্টুনে পড়ে আছে। এগুলো দেখলেই মনে হয়, এখানে সেবার চেয়ে অবহেলারই প্রাচুর্য বেশি।
আবার রহস্যজনক কারণে মেয়াদ রয়েছে এমন ঔষধের ইনটেক কার্টুনের দেখা মিলল মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধের সাথে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিডওয়াইফ কর্মকর্তা ও ঝাড়ুদার একে অপরকে দোষারোপ করেন।
সেলবরষ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান গোলাম ফরিদ খোকা জানান, “এ উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসার মান খুবই নাজুক। এখানে কোনো এমবিবিএস ডাক্তার নাই। ভেতরে বসারও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দিকে নজর দেয়া হলে ৩টি ইউনিয়নের হাওরের সহজ, সরল, অসহায় মানুষ উপকৃত হবে।”
কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়া
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ রাবেয়া আক্তার ওষুধ বরাদ্দের কোনো তালিকা দেখাতে পারেননি। আর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুবীর সরকার বলেন, “যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সেলবরষ উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল একসময় হাওরপাড়ের মানুষের আশা। কিন্তু এখন এটি যেন এক মৃতপ্রায় প্রতিষ্ঠান। সরকারি বাজেট আসে, ওষুধ আসে, কিন্তু চিকিৎসা পৌঁছায় না মানুষের হাতে। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ শুধু অপচয় নয়, এটি মানুষের জীবনের সঙ্গে নিষ্ঠুর খেলা।
স্থানীয়রা চাইছেন—অবিলম্বে একজন যোগ্য ডাক্তার নিয়োগ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়মিত খোলা রাখা এবং ওষুধ বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। তাদের কথায়, “চিকিৎসা আমাদের অধিকার। ওষুধ ফেলে রাখার নয়, আমাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।”
এসআর