শুক্রবার নিউইয়র্কের স্থানীয় সকাল সময় ৯টায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে দশম বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দেশের পাচার হওয়া অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধার করা বর্তমানে আমাদের অন্যতম শীর্ষ অগ্রাধিকার। গত ১৫ বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। আমরা নিরলসভাবে এই সম্পদ ফেরত আনার চেষ্টা করছি। তবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনি প্রক্রিয়া এবং নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে আমাদের এই প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দৃঢ় সদিচ্ছা ছাড়া আমরা পাচার হওয়া অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধারে সফল হব না।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশ থেকে সম্পদের এই অবৈধ পাচার কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিধি-বিধানই বিভিন্ন ট্যাক্স হেভেনে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ স্থানান্তরে উৎসাহ দিচ্ছে।
তাই, যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান পাচারকৃত সম্পদ গচ্ছিত রাখার সুযোগ দিচ্ছে, তাদের প্রতি আমি আহ্বান জানাই— তারা যেন এই অপরাধের শরিক না হয় এবং এ সম্পদ তার প্রকৃত মালিক অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ করদাতাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়।
জাতিসংঘ সনদের আট দশক পূর্তি উপলক্ষে সব সদস্য রাষ্ট্রকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত আট দশকে জাতিসংঘ ধারাবাহিকভাবে তার কর্মপরিধি সম্প্রসারিত করেছে এবং নানা ক্ষেত্রে আরও গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে। বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা, মানবাধিকার, বৈশ্বিক জীবনমান উন্নয়ন, ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা ও সমতা প্রসারে জাতিসংঘের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের কারণেই আজ বিশ্বের ১২০টি দেশের প্রায় ১৩ কোটি বিপদাপন্ন মানুষ জরুরি খাদ্য ও মৌলিক মানবিক সহায়তা পাচ্ছে, এবং বিশ্বের ৪৫ শতাংশ শিশুকে টিকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা বহুপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন, টিকা ও অন্যান্য জীবনরক্ষাকারী সেবা পৌঁছে দিচ্ছে।
ড. ইউনূস আরও বলেন, গত বছর এই মহান সভায় আমি দাঁড়িয়েছিলাম সদ্য গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত একটি দেশের রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরতে। আজ আমি বলছি, এই রূপান্তরের অগ্রযাত্রায় আমরা কতটুকু অগ্রসর হয়েছি।
পৃথিবীর প্রতি ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৩ জন বাংলাদেশে বাস করেন—উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভূ-রাজনৈতিকভাবে বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে বাংলাদেশ রয়েছে— একারণে এই ইতিহাস জানা জরুরি নয়, বরং এই বিবরণ সাধারণ মানুষের অসাধারণ ক্ষমতার ওপর আস্থা জোগাবে।
তিনি আরও বলেন, এই বিবরণ বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্য আশা জাগাবে— যে সংকট যত গভীরই হোক না কেন, কিংবা তার সমাধান যত দুরূহই মনে হোক না কেন, উত্তরণের পথ কখনও হারিয়ে যায় না।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল একটি ভারসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা— যেখানে আর কোনো স্বৈরশাসকের আবির্ভাব হবে না, কোনো নির্বাচিত নেতা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপ ক্ষুণ্ণ করতে পারবে না, কিংবা রাষ্ট্র ও জনগণের রক্ষকরা ভক্ষকে পরিণত হবে না।
তিনি জানান, শাসনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম, নারী অধিকারসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে আমরা ১১টি স্বাধীন সংস্কার কমিশন গঠন করেছি। কমিশনগুলো জনমত যাচাই ও গভীর পর্যালোচনার মাধ্যমে বিস্তারিত সংস্কার কার্যক্রম সুপারিশ করেছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনারা জানেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমরা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাশাপাশি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করতে আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে নাগরিকবান্ধব সংস্কার চালিয়ে যাচ্ছি।
আরএন