খুলনার ডুমুরিয়ার সাব-রেজিস্ট্রি অফিস যেন ঘুষের এক স্বর্গরাজ্য। যেকোনো বিষয়ে সামান্য ত্রুটি বা বিচ্যুতির অভিযোগ তুলেই গত কয়েক মাস ধরে এই অফিসে জমি রেজিস্ট্রি আটকে দেওয়া হচ্ছে। তবে অফিস "ম্যানেজ" করলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যায়—এমন অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা।
ডুমুরিয়া উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে জমির দলিল করতে আসা দলিল লেখক, ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বহু বছর ধরেই এখানে ‘অফিস খরচ’সহ নানা নামে কিছু অর্থ দিতে হয়—এই রেওয়াজ মেনেই দলিল রেজিস্ট্রির কাজ চলে আসছে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল ২০২৫-এ মো. নাহিদুজ্জামান সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সামান্য আইনি ত্রুটি বা নামের বানানে ভুল দেখিয়ে বলা হচ্ছে, “এই দলিল হবে না।” ফলে রেজিস্ট্রি আটকে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট দলিল লেখকদের ভাষ্য অনুযায়ী, তখন তারা সাব-রেজিস্ট্রারের একান্তজন (নকল নবিস) তপন মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলেন, এবং যদি ১০-২০-৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে পারেন, তাহলেই সেই জমির রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়।
ডুমুরিয়া উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সীমাহীন দুর্নীতির প্রসঙ্গে—রুজি-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক দলিল লেখক বলেন, আমরা বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে অনেক যাচাই-বাছাই করে দলিল প্রস্তুত করি। কিন্তু সাব-রেজিস্ট্রারের সামনে দাখিল করার পর তিনি খুঁজতে থাকেন কোনো ভুল আছে কি না। অনেক সময় পরচায় যেভাবে নাম লেখা থাকে, এনআইডি-তে সামান্য ভুল থাকলেই তিনি বলেন, ‘এ দলিল হবে না, সংশোধন করে আনো।’ কিন্তু নাম সংশোধন তো মুখের কথা নয়। তাই ঝামেলা এড়াতে তপনের মাধ্যমে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে শুরু করে সমস্যার গুরুত্ব অনুযায়ী ২০-৫০ হাজার এমনকি লক্ষাধিক টাকা দিলে রেজিস্ট্রি হচ্ছে।
এছাড়া নামপত্তন রেকর্ড থাকার পরও বহু পুরোনো পি.টি. দলিল, এস.এ খতিয়ানের অনলাইন কপি চাওয়া হয়। মৌজার নাম বা জে.এল নম্বর এস.এ ও আর.এস পরচায় ভিন্ন হলে রেজিস্ট্রি আটকে যায়। কোনো জমিতে বাড়ি থাকলে তার আংশিক বিক্রি করতে গেলেই তিনি বলেন ৬% উৎস কর দিতে হবে। গুটুদিয়া ইউনিয়নের জমি হলে বলবেন ২% ভ্যাট না দিলে রেজিস্ট্রি হবে না। যত সমস্যাই থাকুক, শেষ কথা—‘তপনের সঙ্গে কথা বলো।’
এ বিষয়ে ডুমুরিয়া দলিল লেখক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন খান বলেন, সর্বশেষ জরিপ (আর.এস) হয়ে যাওয়ার পরও তিনি নেট থেকে এস.এ পরচা, মূল দলিল, নামের সামান্য ভুল পেলেও ১০-২০ হাজার টাকা দিলেই দলিল ছাড়েন। এছাড়া জমির মূল্যের প্রতি লাখে ৩-৪শ টাকা তো এমনিই নেন।
দলিল লেখক সমিতির সভাপতি ফারুক খান বলেন, ডুমুরিয়ার ৭০ জন লেখকের কাছ থেকে আলাদা করে জিজ্ঞেস করলেও এই সাব-রেজিস্ট্রারের অসহনীয় দুর্নীতির কথা জানা যাবে। তিনি দলিলে কোনো না কোনো ভুল বের করে ২০-৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দাবি করেন। এমন দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসার ডুমুরিয়ায় আগে আর আসেনি।
খুলনা জেলা দলিল লেখক সমিতির সাবেক সভাপতি বাহাউদ্দিন খন্দকার বলেন, ডুমুরিয়ার সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে যে-কোনো দলিল নিয়ে গেলে, তিনি কোনো না কোনো অজুহাতে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন।
ডুমুরিয়া উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার মো. নাহিদুজ্জামান তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এস.এ পরচা থেকে বর্তমান পর্যন্ত মালিকানার হিস্ট্রি যাচাই করেই দলিল করা আমার দায়িত্ব। কখনো কখনো মানবিক সহায়তার বিষয়গুলো ভুল বুঝে কেউ কেউ সুবিধা নিতে চায়। তবে আমার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আল-আমিন বলেন, জনস্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে এমন অভিযোগ পেলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব।
খুলনা জেলা রেজিস্ট্রার মো. মিজানুর রহমান বলেন, দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এসএস/আরএন