| BREAKING: |

মাত্র এক বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার পর সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল সালেহা বিবিকে। শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেসময় তাঁকে পড়াশোনা ছেড়ে গৃহস্থালির কাজে যুক্ত হতে হয়। তবে পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়ার যন্ত্রণাটা কখনোই মেনে নিতে পারেননি। মনে মনে সবসময়ই ইচ্ছা ছিল আবার লেখাপড়া করার। কিন্তু সংসারের অভাব-অনটন, ছেলেদের পড়ালেখার খরচ—সব মিলিয়ে তখন আর সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
অবশেষে অনেক দেরিতে হলেও সেই ইচ্ছা বাস্তবায়ন করছেন সালেহা বিবি। চলতি বছর ভবানীগঞ্জ কারিগরি অ্যান্ড ব্যবস্থাপনা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন তিনি। ভবিষ্যতে আইনজীবী হওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তক্তপাড়া গ্রামের গৃহবধূ সালেহা বিবি (৫৩) তক্তপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহার আলীর স্ত্রী। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী সালেহা বিবির জন্ম ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে।
সোমবার (৭ জুলাই) তক্তপাড়া গ্রামে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পড়ার টেবিলে বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সালেহা বিবি। তিনি জানান, আজ তাঁর হিসাববিজ্ঞান পরীক্ষা, তাই পড়ার চাপ একটু বেশি।
সালেহা বিবি বলেন, “লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ থেকেই আবার পড়া শুরু করি। আমাদের পরিবারের সবাই উচ্চশিক্ষিত, আত্মীয়স্বজনরাও তাই। স্বামী ও ছেলেদের উৎসাহে ২০১৯ সালে শ্রীপুর রামনগর টেকনিক্যাল বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের ভোকেশনাল শাখায় নবম শ্রেণিতে ভর্তি হই।”
সেখান থেকে ৪.৬০ জিপিএ পেয়ে এসএসসি পাস করেন তিনি। পরে ভর্তি হন ভবানীগঞ্জ কারিগরি অ্যান্ড ব্যবস্থাপনা কলেজে এবং চলতি বছর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২৬ জুন শুরু হওয়া এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, তাঁর বাবার বাড়ি অর্জুনপাড়া গ্রামে। বাবা আবদুস সাত্তার ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর বিয়ে হয়। সালেহা বলেন, “এই বিয়েতে আমি রাজি ছিলাম না। কিন্তু পরিবারে তখন আমার মতের কোনো মূল্য ছিল না। স্বামীর বাড়িতে এসে সংসার শুরু করি, আর বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা।”
অর্জুনপাড়া গ্রামের নাসের আলী বলেন, “সালেহা ছোটবেলায় খুব মেধাবী ছিল। বাল্যবিয়ের কারণে তার পড়াশোনাটা থেমে যায়। না হলে সে অনেক দূর যেতে পারত।”
সালেহার পরিবারে আছেন স্বামী ও দুই ছেলে। বড় ছেলে শামীম হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। ছোট ছেলে সাগর হোসেন পড়ছেন রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজে।
এই বয়সে আবার লেখাপড়ায় ফেরার বিষয়ে সালেহা বলেন, “আমরা ছয় ভাইবোনের মধ্যে চারজনই উচ্চশিক্ষিত, সবাই শিক্ষকতা পেশায় আছেন। আমি আর পিছিয়ে থাকতে চাই না। সুযোগ পেলে স্নাতক ও এলএলবি শেষ করে আইন পেশায় যুক্ত হতে চাই।”
তক্তপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সালেহার স্বামী শাহার আলী বলেন, “কম বয়সে ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ায় ও লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি, এজন্য নিজেকে অপরাধী মনে হয়। তাই ওকে নতুন করে ভর্তি করিয়ে দিই। এখন সে বেশ ভালো করছে। আমি নিজেই ওকে পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে যাই এবং পরীক্ষা শেষে বাড়ি নিয়ে আসি।”
বড় ছেলে শামীম হোসেন বলেন, “আমাদের পড়াশোনা করাতে মা নিজের পড়াশোনা ত্যাগ করেছিলেন। এখন যখন সুযোগ এসেছে, আমরা মায়ের স্বপ্ন পূরণে পাশে আছি। তাঁর ধৈর্য দেখে আমরা বিস্মিত হই, গর্বও হয়।”
ভবানীগঞ্জ কারিগরি অ্যান্ড ব্যবস্থাপনা কলেজের প্রভাষক মাহবুবুর রহমান মনি বলেন, “সালেহা বিবি আমাদের কলেজের নিয়মিত শিক্ষার্থী। তিনি অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসেই পরীক্ষা দিচ্ছেন। এই বয়সেও তাঁর আগ্রহ সত্যিই প্রশংসনীয়।”
বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহাবুবুল ইসলাম বলেন, “এই বয়সে পড়ালেখার প্রতি এমন আগ্রহ অবশ্যই অনুকরণীয়। সালেহা বিবি অনেকের কাছেই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।”
এএইচ/আরএন