কোরবানির পশুর হাটসহ বিভিন্ন সময়কে টার্গেট করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রীক সক্রিয় হয়ে উঠেছে জালনোট চক্র। বিশেষ করে, চক্রটি সুযোগ বুঝে কক্সবাজারের বিভিন্ন পশুর হাটে জাল নোট ছড়িয়ে দিতে সক্রিয় রয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। জালনোট চক্রকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সতর্ক রয়েছে। চলতি পাঁচ মাসে র্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) পৃথক অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ জালনোটসহ ১৪ জনকে গ্রেফতার করেছে এবং উদ্ধার করা হয়েছে জালনোট তৈরির সরঞ্জাম।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্ধার অভিযান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে জালনোটসহ গ্রেফতারকৃত অধিকাংশই রোহিঙ্গা। ধারণা করা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রীক জালনোট চক্রের বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যসূত্র বলছে, বড় পশুর হাটগুলোতে জালনোট শনাক্তকারী মেশিনসহ পুলিশের পৃথক টিম মাঠে কাজ করছে।
কক্সবাজার প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যসূত্র বলছে, এই বছর কক্সবাজারে পশুর চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার, মজুদ রয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার। অন্য একটি সূত্র বলছে, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে পশু আসার কারণে স্থানীয় খামারিরা চরম বিপাকে পড়েছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্যসূত্র বলছে, এ বছর কক্সবাজার জেলায় ৯৪টি পশুর হাট বসছে। এর মধ্যে স্থায়ী বাজার ৪৮টি, কোরবানিকে কেন্দ্র করে ৪৬টি। উপজেলা ভিত্তিক অনুমোদিত বাজারের সংখ্যা হলো: সদরে ১৪টি, রামুতে ১৩টি, চকরিয়ায় ১৬টি, পেকুয়ায় ৮টি, উখিয়ায় ৮টি, টেকনাফে ৭টি, মহেশখালীতে ৬টি, কুতুবদিয়ায় ৬টি। তবে বেসরকারি হিসাবে বাজারের সংখ্যা শতাধিক বলে জানা গেছে।
এদিকে সদরে ১৪টি কোরবানির পশুর হাট ইজারা হলেও প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্যমতে পশুর হাট বসছে ৭টি। ইতোমধ্যে বাজারগুলোতে বিক্রি শুরু হয়েছে। অনেক বাজারে মিয়ানমারের গরু-মহিষ সয়লাব হতে দেখা গেছে। গত বুধবার খুরুলিয়া বাজারে গরু বিক্রি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ইজারাদার। সেদিন নিয়মিত হাটবারের পাশাপাশি কোরবানির পশুর হাটও ছিল। খুরুলিয়া বাজারে সহস্রাধিক গরু-মহিষ মজুদ রয়েছে। গত বছর গরুর সারি প্রায় আধা কিলোমিটার পর্যন্ত সড়কজুড়ে ছিল। এ বছর প্রচুর গরু বাজারে সরবরাহ থাকলেও মাঝারি মানের গরুর দাম বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে সীমান্তবর্তী রামু গর্জনিয়ার আলোচিত বাজারটি গেল সোমবার ও গতকাল বৃহস্পতিবারও বন্ধ রয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) রাজেশ বড়ুয়া জানিয়েছেন, সীমান্ত দিয়ে পশু পাচার রোধে শৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে। তার আলোকে গতকাল বৃহস্পতিবার সীমান্তের তিতারপাড়া, হাজীর পাড়া এলাকায় যৌথ বাহিনী চেকপোস্ট বসিয়ে নজরদারি জোরদার করেছে।
পাঁচ মাসে শৃঙ্খলা বাহিনীর পৃথক যত অভিযান
কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে বিভিন্ন থানায় মামলাগুলো খতিয়ে দেখা গেছে, র্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও এপিবিএন পৃথক অভিযান চালিয়ে চলতি পাঁচ মাসে নারীসহ ১১ জনকে বিপুল পরিমাণ জালনোটসহ গ্রেফতার করেছেন এবং জালনোট তৈরির সরঞ্জামও উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বেশির ভাগই রোহিঙ্গা।
চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের সহকারী পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) ও সহকারী পুলিশ সুপার আ. ম. ফারুক গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, সম্প্রতি কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় কারখানা স্থাপন করে সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা জাল টাকার তৈরি করছে—এমন খবর পায় র্যাব। তার সূত্র ধরে চকরিয়ার খুটাখালী ইউনিয়নের গর্জনতলী এলাকায় গোপন কারখানা স্থাপন করে চক্রটির কতিপয় লোকজন জাল টাকা তৈরির খবরে র্যাবের একটি দল অভিযান চালায়। এতে সন্দেহজনক কারখানাটি ঘিরে ফেললে র্যাব সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে ৩/৪ জন লোক দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় ধাওয়া দিয়ে দু’জনকে আটক করা সম্ভব হলেও অন্যরা পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া যায় জাল নোট তৈরির ১,০০০ টাকার ২৭টি বান্ডিল ও ৫০০ টাকার ৩৩টি বান্ডিল, জাল নোট তৈরির একটি যন্ত্র এবং ৫০টি ল্যামিনেটিং পেপার।
ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, চকরিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, র্যাবের মামলাটি নিবিড়ভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। ধৃত আসামিদের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে রিমান্ড আবেদন করা হবে শিগগিরই।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)-এর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শুধু জালনোট তৈরি নয়, এমন কোনো অপরাধ নেই যাতে রোহিঙ্গারা জড়িত নয়। তার মতে, বেকারত্বের কারণে রোহিঙ্গারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
রামু থানায় বিজিবির দায়ের করা একটি মামলার সূত্রে জানা গেছে, রামু ব্যাটালিয়নের ৩৪ বিজিবির সদস্যরা উপজেলার খুনিয়াপালং এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২ লাখ ৪৯ হাজার টাকাসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করেন।
যা বললেন জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ
কক্সবাজার জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এ. এম. খালেকুজ্জামান জানিয়েছেন, এ বছর কক্সবাজারে পশুর চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার, মজুদ রয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার। ঈদ বাজারে কোরবানির পশু পরীক্ষার জন্য প্রাণিসম্পদ দপ্তরের পক্ষ থেকে থাকবে পশু টেস্ট মেডিকেল টিম। জালনোট সনাক্তকরণে বাজারে থাকবে বিশেষ জালনোট সনাক্তকারী মেশিন।
যা বললেন জেলা পুলিশের মুখপাত্র
কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসীম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, পশুর হাটে জালনোট শনাক্ত, ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য রোধে এবং ক্রেতা-বিক্রেতাদের সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে পুলিশের বিশেষ টিম। তিনি অপরাধ নির্মূলে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
যা বললেন জেলা প্রশাসন
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন বলেন, কোরবানির পশুর হাটের নানা বিষয় নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এছাড়া ক্রেতা-বিক্রেতাদের নির্বিঘ্নে পশু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য প্রতিটি বাজারে নিরাপত্তা জোরদারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সর্বসাধারণ যাতে নির্বিঘ্নে পশু ক্রয়-বিক্রয় করতে পারেন সে ব্যাপারে পুলিশকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বাজারে ১টি করে পুলিশের মোবাইল টিম কাজ করবে, পাশাপাশি সাদা পোশাকে ও বিশেষ পুলিশ সদস্যরাও আলাদাভাবে মোতায়েন থাকবে।
এসইউ/আরএন