দেশের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ সয়াবিন লক্ষ্মীপুরে উৎপাদন হয়। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি আবাদ, বাম্পার ফলন, টানা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় লক্ষ্মীপুর সয়াবিনের রাজধানী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
১৯৮২ সালে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার হায়দারগঞ্জে প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে সয়াবিনের চাষ করে মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি (এমসিসি) নামে একটি সংস্থা। উৎপাদন উপযোগী উর্বর মাটি ও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে প্রথমবারেই উৎপাদনে আসে সফলতা। এরপর জেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাবে শুরু হয় সয়াবিন চাষ। এখন দেশের উৎপাদিত সয়াবিনের প্রায় ৮০ ভাগই উৎপাদন হয় লক্ষ্মীপুর জেলায়।
সয়াবিন থেকে পোলট্টি খাদ্য, ফিশ ফিড, সয়া নাগেট, সয়াবিস্কুট, সয়ামিট, সাবান, সয়াদুধ, শিশু খাদ্যসহ ৬১টি ধরনের পুষ্টিকর খাদ্য ও পণ্য তৈরিতে ব্যবহার হয় বলে কৃষি বিভাগ জানায়।
লক্ষ্মীপুরে উৎপাদিত সয়াবিন থেকে সরাসরি তৈল উৎপাদন না হওয়ায়, উৎপাদিত সয়াবিন ব্যবহার করে তৈল উৎপাদনের শিল্প কারখানা গড়ে না উঠায়, সর্বোপরি কৃষকরা ন্যায্য দাম না পাওয়ায় প্রতি বছর কমছে সয়াবিনের আবাদ।
কৃষি বিভাগ বলছে, উচ্চফলনশীল নতুন জাতের বিইউ-১, বিইউ-২, বারি-৫ ও ৬, বিনা-৫ ও ৬ জাতের সয়াবিন চাষ করায় এবার উৎপাদন বেড়েছে। এতে ৬০০ কোটি টাকারও বেশি সয়াবিনের বাণিজ্য করেছেন ব্যবসায়ীরা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সয়াবিন উৎপাদন আরো বাড়বে। সে লক্ষ্যে কৃষি বিভাগ মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে সবুজের সমারোহ। ভালো ফলন এবং লাভের আশায় ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ বেশি হওয়ায় দিন দিন সয়াবিন চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন চাষিরা। অনুকূল আবহাওয়া, সময়মতো উন্নত জাতের বীজ রোপণ ও কীটনাশক ব্যবহার করতে পারায় বাম্পার ফলনের আশা করছেন তারা।
আবুল হাসেম নামে এক কৃষক বলেন, আমরা উন্নত জাতের সয়াবিন চাষ করছি। এবার আবহওয়াও ভালো। আশা করি লাভবান হবো।
রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষক করেছেন সয়াবিনের আবাদ।
কেবল এ ইউনিয়ন নয়, লক্ষ্মীপুর জেলার অনেক এলাকায় প্রায় দুই যুগ ধরে করা হচ্ছে সয়াবিনের চাষ। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে মোট উৎপাদিত সয়াবিনের ৮০ শতাংশই মিলছে লক্ষ্মীপুর থেকে। আগে আমন মৌসুম শেষে অনাবাদি পড়ে থাকত ফসলি জমি। এসব জমিতেই সয়াবিনের আবাদ করা হচ্ছে।
কৃষকরা জানান, আগামী মে মাসের দিকে ফলন পাওয়া যাবে।
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এবার ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে এর চেয়ে আরও ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর বেশি জমিতে সয়াবিনের আবাদ করা হয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছরে জেলায় অন্তত ৮৪ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে, যার বাজার মূল্য ৩২০-৩৫০ কোটি টাকা। দেশের খ্যাতনামা ভোজ্যতেল ও পোলট্রি খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব সয়াবিন সংগ্রহ করেন। জেলার কমলনগর, রামগতি, রায়পুর ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সয়াবিন আবাদ হয়।
রায়পুর উপজেলার চারটি ইউনিয়নে সয়াবিন চাষ হয়। বিশেষ করে মেঘনা নদীর জেগে ওঠা চরাঞ্চল চরইন্দুরিয়া, চরজালিয়া, চরঘাসিয়া, চরকাছিয়া ও কানিবগা এলাকায় কয়েক হাজার একর জমিতে সয়াবিনের চাষ হচ্ছে। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, হাজীপাড়সহ আটটি ইউনিয়নে চাষ হয় সয়াবিনের। রামগতি ও কমলনগর উপজেলায়ও অনেক এলাকায় সয়াবিনের আবাদ করা হচ্ছে।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, এ অঞ্চলের উর্বর মাটি সয়াবিন চাষের জন্য উপযোগী। এখানকার মাটি দোআঁশ জাতীয়। এ মাটিতে একবার লাঙল চালালেই তা সয়াবিন চাষের উপযোগী হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে প্রতি বছর ফলন লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যায়। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত আবাদের উপযুক্ত সময়। শিম জাতীয় গাছ হওয়ায় সয়াবিন ক্ষেতে খুব একটা সার দিতে হয় না। ক্ষেতে নিড়ানি দিয়ে আগাছাও পরিষ্কার করা লাগে না। গাছ বড় হলে এক-দুবার কীটনাশক দিতে হয়। চারা গজানোর ১৩০ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে আসে।
রায়পুরের চর কাছিয়ার কৃষক ফারুক গাজী চলতি বছর প্রায় দেড় একর জমিতে সয়াবিন চাষ করেছেন। গত বছর করেছিলেন এক একর জমিতে। তিনি জানান, ফসল ঘরে আনা পর্যন্ত তার মোট খরচ হবে ২৫ হাজার টাকার মতো। উৎপাদন স্বাভাবিক হলে ৭০ মণ সয়াবিন পাওয়া যাবে। প্রতি মণ ১ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি করলেও প্রায় ১ লাখ টাকা আয় হবে তার।
কৃষকরা জানান, সয়াবিন আবাদে খরচ কম। রোগ ও পোকার আক্রমণও কম হয়। চাষাবাদের পদ্ধতি সহজ। বিক্রি করলে আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়া যায় ধানের চেয়েও বেশি। যে কারণে সয়াবিন চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে।
জমির মালিক ও বর্গা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে চরাঞ্চলে অনেক জমি অনাবাদি পড়ে থাকত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে অনাবাদি জমি পড়ে থাকতে দেখা যায় না। পরিত্যক্ত জমিতেও সয়াবিন চাষে সাফল্য মিলছে।
রায়পুরের হায়দরগঞ্জ বাজারের চেহারা গত ২০-২২ বছরে অনেকটাই বদলে গেছে কেবল সয়াবিনের কারণে। ছোট বাজারটির ৪৫ থেকে ৫০টি আড়তে এখন পাইকারি ভাবে সয়াবিন বিক্রি হয়।
বাজারের সয়াবিন ব্যবসায়ী সাইজুদ্দিন মোল্লা জানান, দেশে উৎপাদিত সয়াবিনের ৭০ শতাংশের বেচাকেনা হয় এই বাজারে। বাজারেই গড়ে উঠেছে সয়াবিনের ১০টি চাতাল। পার্শ্ববর্তী খাসের হাট ও মোল্লার হাট বাজারেও আছে সয়াবিনের ২০টি আড়ত। বিশেষ করে এপ্রিল ও মে মাসে ক্রেতাদের আনাগোনা বেড়ে যায় এসব বাজারে।
আল হাবিব গ্রুপের ম্যানেজার জামাল হোসেন মিয়াজী জানান, সয়াবিনের লক্ষ্যমাত্রা ও উৎপাদন বাড়লেও ডলার সংকটের কারণে এলসি না খোলায় ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, সয়াবিন তেলজাতীয় শস্য। গাছ ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার উঁচু হয়। গাছের কাণ্ডে ফুল হয়। ফুল থেকে শিমের মতো চড়াতে বীজ জন্মে, এই বীজগুলোকেই সয়াবিন বলা হয়। সয়াবিন ভোজ্যতেলের প্রধান উৎস। এটি অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। কচি ও শুকনা সয়াবিন বীজ সবজি ও ডাল হিসেবে খাওয়া হয়। পরিণত সয়াবিন বীজ থেকে শিশুখাদ্য, সয়া দুধ, দই, পনির, বিস্কুট, কেকসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার তৈরি হয়ে থাকে। এছাড়া পোলট্রি ও ফিশ ফিড তৈরি, রং, সাবান, প্লাস্টিক মুদ্রণের কালি ইত্যাদি দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সয়াবিন একটি অপরিহার্য উপাদান।
লক্ষ্মীপুরে প্রতি বছরই সয়াবিনের আবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে জানান লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দীন ফিরোজ। তিনি জানান, এ অঞ্চলের মাটি সয়াবিন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এরই মধ্যে লক্ষ্মীপুর ‘সয়াল্যান্ড’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দেশের মোট উৎপাদিত সয়াবিনের ৮০ শতাংশ চাষাবাদ হয় লক্ষ্মীপুর জেলায়।
শামসুদ্দীন ফিরোজ জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লক্ষ্মীপুরে এবার সয়াবিনের বাম্পার ফলন হবে। ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না এলে কৃষকদের প্রত্যাশা পূরণ হবে। কাঙ্ক্ষিত ফলন পেতে কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
ডব্লিউআর/এমএ