সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনের শর্ত ভঙ্গ করে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি এবং ফ্যাসিবাদি নিয়ম-কানুন করে মাত্র ৩২ জন নিয়ে পরিচালনার বিরুদ্ধে রংপুরে কর্মরত প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া ও সরকার অনুমোদিত অনলাইনে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীদের অব্যাহত দাবির মুখে অবশেষে রংপুর প্রেসক্লাবের কমিটি বিলুপ্ত করে উম্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) মোঃ ময়নুল হক।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রংপুরে কর্মরত অন্তত দেড় শতাধিক গণমাধ্যমকর্মীর উপস্থিতিতে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এছাড়াও ক্লাবের বিদ্যমান সবকিছু সিজারলিষ্ট তৈরি করে ক্লাব পরিচালনার দায়িত্ব নেন। এসময় রংপুর থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিকের সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, রংপুর সম্মিলিত সাংবাদিক সমাজ, রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন-আরপিইউজে, রংপুর রিপোর্টার্স ক্লাব, সিটি প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ক্লাব রংপুর, রংপুর রিপোর্টার ইউনিটি, টেলিভিশন ক্যামেরা জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশন, রংপুর ফটো জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশন, রংপুর অনলাইন রিপোর্টার্স ফোরাম, বৈষম্য বিরোধী সাংবাদিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ, সদস্য ছাড়াও রংপুরে কর্মরত দেড় শতাধিক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর ও জেলা নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত হন।
এর আগে প্রশাসক চিঠি দিয়ে রংপুরে বিদ্যমান সকল সাংবাদিক সংগঠন, স্থানীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকদের দায়িত গ্রহণ অনুষ্ঠান অবহিত করতে চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ জানান।
দায়িত্বভার গ্রহণ করে এডিসি ময়নুল হক বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের স্বেচ্ছাসেবি সমাজকল্যান সংস্থা সমূহ (রেজ্রিষ্ট্রেশন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ধারা ৯ উপধারা ২ মোতাবেক জারিকৃত আদেশ সংশোধন পূর্বক আমাকে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়। আমি পুলিশ এবং রংপুরের গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতিতে বিকেলে প্রেসক্লাবে আসি। একটি গেট বন্ধ পাই। অন্য গেট খোলা থাকায় সেটি দিয়ে প্রেসক্লাবে প্রবেশ করি।
তিনি বলেন, এখন থেকে ১৯৬২ সলে সংস্থার আইন অনুযায়ী প্রশাসক হিসেবে আমি প্রেসক্লাবের কার্যনির্বাহী পর্ষদের সকল দায়িত্ব পালন করবো। এছাড়াও গঠনতন্ত্র অনুসারে সদস্য হালনাগাদ, খসরা ভোটার তালিকা প্রনয়ন করে কার্যনির্বাহী পরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্বভার হস্তান্তর করবো। ক্লাবের ৬ তলা ভবনসহ স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্বি কোন সদস্য ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করাসহ দোকান ভাড়া বা দোকান উন্নয়ন করার ক্ষেত্রে আগের উদ্যোগ যাছাই করা হবে। দেশের স্বনামধম্য প্রতিষ্ঠান দিয়ে সরকারি খাস জমি বন্দোবস্তের নিয়ম অনুযায়ী আয়-ব্যয়ের হিসাব অডিট করার বন্দোবস্ত করা হবে। আর্থিক অনিয়ম প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রতিষ্ঠাকালীন গঠনতন্ত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধন এনে সমাজসেবার অনুমোদন নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা হবে। সেই গঠনতন্ত্রের আলোকে রংপুরের যোগ্য ও আগ্রহী সাংবাদিকবৃন্দকে সদস্য করে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হবে।
এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন রংপুরে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীরা।
রংপুর অনলাইন রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি এটিএন নিউজের প্রতিনিধি শাহরিয়ার মিম জানান, এটি ঐতিহাসিক উাদ্যোগ। রংপুরে কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য প্রেসক্লাবে সরকার জায়গা দিলেও তারা নানা কালা নিয়মকানুন করে গণমাধ্যমকর্মীদের বঞ্ছিত করেছে। অনলাইনের সাংবাদিকরা প্রেসক্লাবে আবেদন করারই সুযোগ রাখা হয় নি। এটি বৈষম্যের বড় উদাহরণ। অনলাইনের সাংবাদিকদেরও সদস্য অন্তর্ভূক্তি করতে হবে।
বাংলাদেশ ফটো সাংবাদিক এসোসিয়েশনের সভাপতি দৈনিক পরিবেশের ফটো সাংবাদিক মমিনুল ইসলাম রিপন বলেন, ফটো সাংবাদিকতা সর্বজন বিদিত। কিন্তু রংপুর প্রেসক্লাবে ফটো সাংবাদিকরা সদস্য হিসেবে আবেদনই করতে পারতো না। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার ছিলাম। আমরা চেয়েছি সমাজসেবার মাধ্যমে এর প্রতিকার পেতে। এখন আমরা চাই, প্রতিষ্ঠাকালীন গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ফটো সাংবাদিকদের সদস্য অন্তুর্ভূক্তির সুযোগ দিতে।
টেলিভিশন ক্যামেরা জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশনে সাবেক সহ-সভাপতি ও চ্যানেল ২৪ এর ভিডিও সাংবাদিক সাদ্দাম হোসেন ডেমি জানান, আমরা ভিডিও সাংবাদিকরা রংপুর প্রেসক্লাবে সদস্য হিসেবে আবেদনই করতে পারতাম না। বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর কোন দেশে এধরণের কোন নিয়ম না থাকলেও এই ক্লাবে সেটি ছিল। আমরা এই বৈষম্যের অবসান চাই। ভিডিও সাংবাদিকদের প্রেসক্লাবে আবেদনের সুযোগ করে দিতে হবে।
রংপুর রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি শরিফা বেগম শিউলী বলেন, রংপুরে প্রায় ২০০ সাংবাদিক কর্মরত। কিন্ত প্রেসক্লাবে সদস্য মাত্র ৩২ জন। এটা কেন হয়েছে। সেটা ভাবার জন্য প্রমাণ লাগে না। সরকার জমি দিয়েছে সব সাংবাদিকদের জন্য। কিন্তু তারা বিভিন্ন কালো আইন করে সাংবাদিকদের সেখানে সদস্য পদ দেয় নি। এমনকি সমাজসেবাকে অবহিতও করেনি। আমরা এর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন থেকে লড়াই করেছি। এখন চাই সকল পেশাদার সাংবাদিকদের সদস্যভূক্ত করে নির্বাচন।
বৈষম্য বিরোধী সাংবাদিক আন্দোলনের সমন্বয়ক এসএম জাকির হোসেন ও রবিন চৌধুরী রাসেল জানান, ৫ আগস্টের পর আমরা প্রেসক্লাব ফ্যাসিবাদীদের কর্তৃক কুক্ষিগত করে রাখার বিরুদ্ধে এবং অনিয়ম ও দুর্ণীতির বিচারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলাম। কিন্তু প্রেসক্লাব কুক্ষিগতকারীরা নানা নাটক সাজিয়ে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করেছে। এখন প্রশাসক নিয়োগ হয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালীন গঠনতন্ত্রের আলোকে প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি ইলেকট্রনিক্স, অনলাইন, ফটো ও ভিডিও সাংবাদিকদের সদস্য করে নির্বাচন দিতে হবে। এবং যে লুটপাট হয়েয়ে বিগত সময়ে তা তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
রংপুর সিটি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক করতোয়ার প্রতিনিধি হুমায়ুন কবির মানিক জানান, এই উদ্যোগের মাধ্যমে রংপুরের সাংবাদিকদের দীর্ঘদিনের চাওয়া পূরণ হয়েছে। এখন প্রয়োজন বাস্তবায়ন। কেউ যেন কোনভাবেই এই উদ্যোগ বানচাল করতে না পারে সেজন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
রংপুর রিপোর্টার্স ক্লাবের সভাপতি আব্দুল আজিজ চৌধুরী সাঈদ বলেন, রংপুর প্রেসক্লাব নিয়ে সাংবাদিকদের ক্ষোভের অন্ত নেই। সকল সাংবাদিকের হক মেরে মাত্র ৩২ জন সদস্য সুবিধা পেয়েছেন। আজকে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে সেটির অবসান হলো। এখন দ্রুত গতিতে সদস্য অন্তর্ভূক্তি করে নির্বাচেনর ব্যবস্থা করতে হবে।
সম্মিলিত সাংবাদিক সমাজের সদস্য সচিব একুশে টেলিভিশন, দৈনিক সংবাদ এবং বাংলা ট্রিবিউনের বিভাগীয় প্রতিনিধি লিয়াকত আলী বাদল বলেন, ১৯৯১ সালে আমি যখন সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। তখন প্রেসক্লাবের জমি রেজিষ্ট্রেশন হয়েছিল। তারপর সমাজসেবার মূল গঠনতন্ত্র কাটাছেড়া করে প্রেসক্লাবটিকে কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছে। সদস্য হওয়ার জন্য ভোটাভুটির মতো সিস্টেম করে বাণিজ্য করা হয়েছে।
‘৩৪ বছরে এখানে মাত্র সদস্য ৩২ জন। এটা খুবই খারাপ হয়েছে। একারণে রংপুরের সাংবাদিকরা বিভিন্ন সংগঠন করে ঐক্য ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। মাদার সংগঠন হিসেবে প্রেসক্লাবের সদস্যরা শুধু সুবিধা নিয়েছে। বঞ্ছিত হয়েছে সাংবাদিকরা। সমাজসেবা ও প্রশাসনের উদ্যোগে সাংবাদিকরা খুব খুশি। এখন আমরা চাই প্রতিষ্ঠাকালীন সমাজসেবা কর্তৃক অনুমোদিদ গঠনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় ধারা সংশোধন করে পেশাদার সাংবাদিকদের সদস্য হিসেবে অন্তুর্ভূক্ত করা এবং নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পাশাপাশি অনিয়মের তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ।’
স্থানীয় দৈনিক আমাদের প্রতিদিনের সম্পাদক এবং দৈনিক যুগান্তরের ব্যুরো প্রধান ও প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মাহবুব রহমান হাবু বলেন, প্রেসক্লাবের সমাজসেবার অনুমোদিত গঠনতন্ত্রে ছিল স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকরা পদাধিকার বলে সেখানকার সদস্য হবেন। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে ভোটাভুটির মতো সিস্টেম চালু ছিল। রংপুরের সাংবাদিকরা একাট্টা হয়েছে। এখন প্রয়োজন শুধু কমিটি বিলুপ্ত নয়, পূর্বের সকল সদস্যদের বাতিল করে নতুন করে সদস্য গ্রহন। নির্বাচন এবং অনিয়মের তদন্ত করা। এটা করা হলে রংপুরের সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশাকে এগিয়ে নিতে পারবে।
দৈনিক দাবানল সম্পাদক খন্দকার মোস্তফা সরওয়ার অনু বলেন, সরকারের এই উদ্যোগে রংপুরে কর্মরত সাংবাদিকদের একসাথে প্রেসক্লাবে থাকার সুযোগ তৈরি হলো। যে কারণে প্রশাসক নিয়োগ করা হলো সেটি বাস্তবায়ন করা হলে রংপুরের সাংবাদিকরা আরও ঐক্যবদ্ধ হবে।
রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন-আরপিইউজে সভাপতি দৈনিক দিনকালের ব্যুরো প্রধান সালেকুজ্জামান সালেক জানান, প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রেসক্লাবে এখন রংপুরে পেশাদার সাংবাদিকরা সদস্য হিসেবে স্থান পাবেন। রংপুরের সাংবাদিকদের ঐক্য আরও মজবুত হবে। এজন্য তিনি প্রশাসককে অবিলম্বে গঠনতন্ত্রে প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক্স, অনলাইন, ভিডিও ও ফটো সাংবাদিকদের আবেদনের সুযোগ রেখে সংশোধন সাপেক্ষে সদস্য পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়ার আহবান জানান।
তিনি আরও বলেন, সরকার এবং রংপুরের সকল গণমাধ্যমকর্মীর এই আকাঙ্খাকে মুষ্টিমেয় কেউ কোনভাবে বানচাল করার চেষ্টা করলে সাংবাদিক সমাজ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।
এদিকে অবহিত করন সভা শেষে নব নিযুক্ত প্রশাসক ময়নুল হক কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে প্রেসক্লাবে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের একটি তালিকা প্রনয়ন করা হয়।
এলওয়াই/এসআর