‘তখন বেলা ১১টা থেকে সোয়া ১১টা হবে। কাঁকন বাহিনী স্পিডবোটে করে আসে। স্পিডবোটে থেকেই অতর্কিত গুলি করতে শুরু করে। ওরা গুলি করছে, আমরা গুলির ভয়ে কাঁশবনের ভেতরে শুয়ে আছি। তারা আট জন ছিল, কিছু না হলেও দুই ঘন্টা গুলি করেছে। তারা দুটি স্পিডবোটে এসেছিল। একটা স্পিডবোট লোক নামিয়ে চলে যায়। পরে আবার ফিরে আসে। আমাদের কাছে অস্ত্র নাই, মেশিন নাই, ঢাল নাই।’
পদ্মা মধ্যে হবিরচরে গোলাগুলির ঘটনায় নিহত নাজমুলের বাড়ির পাশে মঙ্গলবার সকালে বাঘা উপজেলার নীচ খানপুর গ্রামে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন জলিল সরদারের ছেলে মিঠু সরদার।
তিনি গত সোমবার (২৭ অক্টোবর) চরে গোলাগুলির সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন।
মিঠু বলেন, ‘প্রথমে আমানের মাথায় গুলি লাগে। তাকে দেখে নাজমুল চিৎকার দিয়ে উঠে। এ সময় আমানকে ধরতে গিয়ে নাজমুলেরও গুলি লাগে। তখন আমান বলে আমি আর বাঁচব না। এরপরে আর একটাও কথা বলেনি। আমাদের মধ্যে থেকে একজন কৌশলে এলাকায় ফোন করে। এলাকার লোকজন আসার আগেই কাঁকন বাহিনীর লোকজন সবাইকে ঘিরে ফেলে। তখন নামজুলও বলে উঠে মামা আমি মরে যাব। আমি বাঁচব না।’
তিনি বলেন, ‘যখন তারা গুলি চালাচ্ছিল তখন আমি শুয়ে পড়ি। তাদের আট জনের হাতে অস্ত্র ছিল। তিনটা লোক আমি চিনেছি- চাকলাইয়ের ময়না, সাগর, ফিলিপ নগরের বুরবক। ওদের কাছে বড় বড় অস্ত্র। মোবাইল বের করতে পারিনি। কি করে ফোন করব। মাথার উপর দিয়ে গুলি যাচ্ছে, জান বাঁচানই ফরজ কাজ। আমরা তো সাধারণ লোক। আমরা মাঠ দেখতে গিয়েছি। আমার এই মাঠে দেড়শ বিঘা জমি আছে। জোর করে খড় কেটে নেয় কাঁকন বাহিনীর লোকজন।’
এর আগে সোমবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে রাজশাহীর বাঘা, নাটোরের লালপুর, পাবনার ঈশ্বরদী এবং কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তের পদ্মার চরের নীচ খানপুরের হবির চরের দক্ষিণে চৌদ্দ হাজারি মাঠ এলাকার সংযোগস্থল পদ্মার চরে খড় কাটাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলির ঘটনায় মারা গেছেন খানপুরের মিনহাজ মন্ডলে ছেলে আমান মন্ডল (৩৬), একই গ্রামের শুকুর মন্ডলের ছেলে নাজমুল হোসেন (৩৩)।
এ ঘটনায় খানপুরের তজ্জুল মন্ডলের ছেলে রুহুল আমিন (৫৫), আশরাফ মন্ডলের ছেলে রাবিক হোসেন (১৮), মন্ডলের ছেলে মুনতাজ মন্ডল (৩২), রুহুল আমিনের নাতী শাওন হোসেন আহত হয়েছেন। পরের দিন মঙ্গলবার হবিরচর থেকে কুষ্টিয়ার লিটন নামের এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে নিহত নাজমুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আহাজারি করছেন তার স্ত্রী শারমিন বেগম। নিহত নাজমুলের দুই মেয়ে। একজনের নাম জান্নাতি (৩) অপরজনের নাম জামেলা খাতুন (২)। পাশে স্বজনরাও কান্না করছেন। মায়ের কান্না দেখে তারাও কান্না করছেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে শারমিন বেগম বলেন, ‘আমার ছোট ছোট দুই মেয়ে। তাদের নিয়ে আমি এখন কোথায় যাব? তাদের কিভাবে বড় করব? তাদের কি খাওয়াব? ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে আমি অথৈ সাগরে পড়ে গেলাম।’
স্বজনরা বলছেন, গুলি লাগার পর থেকে একই ভাবে কান্না করছেন শারমিন। নাজমুলের মৃত্যুর খবরে সারা রাত কান্না করেছে সে। এখন ঠিক মত কথা বলতে পারছেন না। শুধু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছে।
নাজমুলের বাড়ির পাশে জুয়েলের মুদির দোকান। দোকানের পাশে বাঁশের মাচা পাতা রয়েছে। সেই মাচায় বসে রয়েছেন আহত নিহতের স্বজনরা। এ ঘটনায় তিন জন নিহত হলেও আহত হয়েছেন ছয় থেকে সাত জন। এছাড়া, গুরুতর আহত আশরাফ মন্ডলের ছেলে রাকিব হোসেন, চান মন্ডলের ছেলে মুনতাজ মন্ডল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, ১৭ বছর আগে হবির চরের নীচ খানপুর এলাকায় ৩০ থেকে ৩৫ পরিবার বসবাস করত। নদী ভাঙনের কারণে তারা ভিটা ছাড়া হয়ে যায়। এরপর তারা বাঘার চর নীচ খানপুর এলাকায় বসবাস শুরু করে।
তাদের দাবি, ওই চরে তাদের প্রায় ৯০০ থেকে ১ হাজার বিঘা জমি রয়েছে। সেগুলোর দলিলও তাদের বাবা-দাদার নামে রয়েছে। তারা সেখানে বিভিন্ন চাষাবাদ করে আসছিল। বিগত কয়েক বছর ধরে কাঁকন বাহিনীর লোকজনের কারণে জমির ফসল নিয়ে আসতে পারেন না। ঘটনাস্থলে পুলিশের বড় বড় কর্মকর্তারা যাবেন। তাই তারা সকাল ১০টার দিকে ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
জানা গেছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিহত আমান মন্ডল ও নাজমুল হোসেনের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সে সময় আহাজারিতে ভেঙে পড়েন স্বজনরা। পরে তাদের স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এর আগে নিহত আমান ও নাজমুলের মরদেহ রামেক হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। আর কুষ্টিয়ার দৌলতপুর পাওয়া লিটনের মরদেহ কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে রয়েছে।
এ বিষয়ে বাঘা থানার ওসি তদন্ত সুপ্রভাত মন্ডল বলেন, ‘এই ঘটনা দৌলতপুর থানায় মামলা হবে।’
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবুর রহমান বলেন, ‘এ ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি। মামলার প্রস্তুতি প্রক্রিয়াধীন।’
এএইচ/এমএ