কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে কমছে দুধকুমার নদীর পানি। তীব্র স্রোতে তা প্রবাহিত হয়ে আঘাত হানছে নদীর কিনারে। দেখা দিচ্ছে বড় বড় ফাটল। পরক্ষণেই তা সশব্দে ধসে যাচ্ছে। বিলীন হচ্ছে একের পর এক জনপদ। ভেঙে যাচ্ছে বসতভিটা, ফসলি জমি, বাগান ও স্থায়ী স্থাপনা। ঘরবাড়ি হারিয়ে মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে অন্যত্র। উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের কুটিরচরে দেখা গেছে এমন চিত্র। গত এক মাসে এখানে বসতভিটা হারিয়েছে ২৬টি পরিবার।
বামনডাঙ্গার বুক চিরে প্রবাহিত প্রমত্তা দুধকুমার নদ। এর ভাঙনের নেশায় প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে মানচিত্র। এক সময়ের সমৃদ্ধশালী ইউনিয়নটির অবস্থা এখন বেশ নাজুক। সহায়-সম্বল হারিয়ে মানুষ হয়ে পড়ছে দরিদ্র থেকে অতি দরিদ্র। অনেকে ইতোমধ্যে পাড়ি জমিয়েছে অন্যত্র। দিন যত যাচ্ছে, ততই আগ্রাসী হয়ে উঠছে দুধকুমার। প্রতিনিয়ত পাল্টাচ্ছে গতিপথ, শিকার বানিয়ে গিলে খাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা।
কুটিরচর—সাপখাওয়া ঘাট দিয়ে নৌকায় নদ পাড়ি দিলেই ওপারে বামনডাঙ্গার এই গ্রামটি। মাত্র এক বছর আগেও এখানে উত্তরপাড়া ও দক্ষিণপাড়া নামে দুটি জামাত ছিল। এখন উত্তরপাড়া নেই, দক্ষিণপাড়াও নিশ্চিহ্নের পথে দুধকুমারের করাল গ্রাসে।
গত এক মাসে ভেঙে গেছে দক্ষিণপাড়ার রজব আলী, বাদশাহ মিয়া, সামাদ আলী, সাজু ইসলাম, ভজু মিয়া, বাচ্চু মিয়া, সদা, গুজু, শহিদুল ইসলাম, আব্দুল খালেক, আমজাদ হোসেন, বাহাদুর, আমজাদ আলী, আবুল কাশেম, আবুল হোসেন, সফিকুল ইসলাম, আবু সিদ্দিক, নুর মোহাম্মদ, মনির হোসেন, ধনদ্দি, হোসেন, মোক্তার আলী, সফিক মিয়া, মাইদুলসহ ২৬টি পরিবারের ঘরবাড়ি।
স্থানীয় মফিজুল ইসলাম জানান, বুধবার সকালে তিনি নদ পাড়ি দিয়ে নাগেশ্বরীতে যান। তখন দেখেছিলেন সামাদের বসতভিটায় বড় বড় ফাটল। দ্রুত তারা ঘরবাড়ি ভেঙে, গাছপালা কেটে সরিয়ে নিচ্ছিলেন। বিকেলে ফিরে দেখেন, সেই বসতভিটা পুরোপুরি চলে গেছে নদীর গর্ভে।
সেখানে ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন সামাদ আলী। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “কুমিল্লায় মজুরি করে অনেক কষ্টে ধারদেনা নিয়ে ঘরবাড়ি তুলেছিলাম। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু আজ আর নেই। বউ-বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাব, কী করব—কিছুই বুঝতে পারছি না। অনেক কষ্টে লাগানো কলাবাগানটাও গেছে ভেঙে।”
শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যে ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে সামাদ আলীর ৩ বিঘা, বাদশাহ মিয়ার দেড় বিঘা, শহিদুল ইসলামের ২ বিঘা, ভজুর ১ বিঘা, ফজল হাজীর ৩ বিঘা, জাহিদুলের ১ বিঘা ও নুরনবী মিয়ার ৩ বিঘা জমির মালভোগ কলাবাগান।
ইউপি সদস্য বাবুল মিয়া জানান, “আর কয়েকদিন পরে আমার ১৪ বিঘা জমির ডালক্ষেত থেকে ফসল ঘরে আসত। তার আগেই চোখের সামনে নদী তা গিলে খেল। গত এক সপ্তাহে এভাবেই দুধকুমার গিলে খেয়েছে এ এলাকার প্রায় ৭০ বিঘা জমির ডালক্ষেত। ধানক্ষেতগুলোর অবস্থাও একই।”
তিনি আরও জানান, হুমকির মুখে রয়েছে একটি মসজিদ, একটি দাখিল মাদ্রাসা ও মুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এগুলোর সঙ্গে হয়তো পুরো দক্ষিণপাড়াই বিলীন হয়ে যাবে নদীর গর্ভে। ভাঙনরোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তারা।
এছাড়াও দুধকুমার ভাঙছে বামনডাঙ্গার মুড়িয়া, আদর্শ বাজার, কুটি বামনডাঙ্গা, তেলিয়ানি, বেরুবাড়ীর খেলারভিটা, খামার নকুলা, ইসলামপুর, নুনখাওয়ার মাঝেরচর, চর পাটতলা, গুচ্ছগ্রাম, ব্যাপারীর চর, বারোবিশ, রায়গঞ্জের দামালগ্রাম, কচাকাটার তরিরহাট, কেদারের বালাবাড়ী ও বল্লভেরখাষের বলরামপুর এলাকায়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিব্বির আহমেদ জানান, “বামনডাঙ্গার কুটিরচরসহ উপজেলার বেশ কয়েকটি জায়গায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কথা বলব, যাতে তারা দ্রুত ব্যবস্থা নেয় ভাঙনরোধে।”
কেএস/আরএন