জলজ প্রাণী নিধন, পাখি শিকার, পানি আটকে স্থাপনা নির্মাণে বিপর্যস্ত উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম জলাভূমি চলনবিল। যা নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার অংশজুড়ে বিস্তৃত। প্রায় এক হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এটি এক সময় ছিল উত্তরাঞ্চলের প্রাণভূমি- মাছ, পাখি, কৃষি ও সংস্কৃতির মিলিত প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আজ সেই চলনবিল মৃত্যুপথযাত্রী।
নদী ও শাখা নদীর পলিপ্রবাহে গঠিত এই প্রাকৃতিক জলাভূমি বর্ষায় টইটুম্বুর থাকলেও এখন মাত্র দুই-তিন মাস পানি থাকে। বছরের বাকিটা সময় বিল শুকিয়ে পরিণত হয় চাষযোগ্য জমিতে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, স্থাপনা নির্মাণ, দখল, দূষণ ও নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারে বিলের প্রাণ-প্রবাহ আজ বন্ধপ্রায়।
চলনবিল এক সময় ছিল শতাধিক প্রজাতির দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য।
স্থানীয় জেলেদের মতে, এখন মাছ ধরার সময় আগের তুলনায় মাত্র এক দশমাংশ মাছও ওঠে না। রিং জাল, চায়না দুয়ারি ও সূক্ষ্ম কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহারে বিলের বাঁচা, গজার, ভেদা, সরপুটি, বৌপুটি, কড়ি কাইট্যা, কাছিম, ভোদর, জলকলা, গেচু, শৈবালসহ প্রায় ৪০-৫০ প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী বিলুপ্তির পথে।
স্থানীয় প্রবীণ মৎস্য চাষি আফজাল ফকির বলেন, ''আগে জাল ফেললে ২০-২৫ কেজি মাছ উঠত, এখন ওঠে ২-৩ কেজি। চায়না জালে ছোট মাছ, কাঁকড়া, শামুক সব ধরা পড়ে। তাই দিন দিন মাছ কমে যাচ্ছে।'
পরিবেশবিদদের হিসাব অনুযায়ী, গত দুই দশকে চলনবিলের দেশীয় মাছের ৬০ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে ইতিমধ্যেই।
চলনবিলের মাছের সাথে বিলুপ্ত হচ্ছে জেলেদের পেশাও। জীবিকার তাগিদে অনেকে এখন শামুক-ঝিনুক ও কাঁকড়া নিধনে ঝুঁকছেন। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার কুন্দুইল নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিলশা এলাকায় প্রতিদিন বসছে ‘শামুকের হাট’।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রতি রাতেই টনকে টন শামুক ধরা হয়, যা সকালে প্রতি বস্তা ২০০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এগুলো দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয় হাঁস ও মাছের খাদ্য হিসেবে। প্রতিদিন কয়েক টন শামুক নিধনের ফলে বিলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভয়াবহ ভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
চলনবিল একসময় ছিল পরিযায়ী পাখিদের অভয়ারণ্য। শীত এলেই সাইবেরিয়া, কাজাখস্তান ও নেপাল থেকে হাজারো পাখি আসত এখানে। এখন শিকারিরা বন্দুক, ফাঁদ ও বিষ ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত হত্যা করছে বালিহাঁস, পানকৌড়ি, সারস, বকসহ নানা প্রজাতি।
চলনবিল পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, 'আগে বিলের আকাশ ভরে থাকত পাখির ডাকে, এখন নিস্তব্ধ। পাখি হারালে বিলের পরিবেশ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়বে। বিলের অভ্যন্তরে পানি আটকে রাস্তা ও ঘরবাড়ি নির্মাণের ফলে প্রাকৃতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।'
বিলপাড়ের কৃষক গোলাম সরদার বলেন, 'আগে বিলে মাছ ছিল, পাখি ছিল, গরু চরত। এখন পানি কম, জাল বেশি। সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে।'
নাটোর পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, 'চলনবিলের অন্তত ৩৫ শতাংশ এলাকা এখন দখল হয়ে গেছে। সিংড়া থেকে গুরুদাসপুর হয়ে চলনবিলে প্রবেশের আত্রাই নদীর প্রায় ২০টি নালা বন্ধ হয়ে গেছে, যেগুলো একসময় চলনবিলের রক্তনালি হিসেবে কাজ করত।'
তিনি বলেন, 'প্রাকৃতিক রূপ ফিরিয়ে আনতে হলে এখনই অভিযান চালিয়ে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ ও নালাগুলোর প্রবাহ ফিরিয়ে দিতে হবে।'
গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা আফরোজ বলেন, 'চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রশাসন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। অবৈধ জাল ধ্বংস ও পাখি শিকার রোধে অভিযান চলছে। এত বিশাল এলাকা রক্ষা করতে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি।'
গুরুদাসপুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা রতন চন্দ্র সাহা বলেন, 'দেশীয় মাছ পুনরুদ্ধারে চলনবিলে অভয়াশ্রম গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা ও আইন প্রয়োগ প্রয়োজন।'
নাটোর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রুহুল আমিন আল ফারুক বলেন, 'অবৈধ জাল, শিকার ও দখলের কারণে চলনবিলের মাছ, পাখি ও জলজ প্রাণী দ্রুত বিলুপ্তির পথে। চলনবিলকে রক্ষা না করলে হারাবে শুধু জীববৈচিত্র্য নয়, উত্তরাঞ্চলের জীবিকা ও সংস্কৃতিও।'
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, 'চলনবিল বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থা। আগে এখানে প্রায় শতাধিক প্রজাতির মাছ ও অর্ধশতাধিক প্রজাতির দেশীয় ও পরিযায়ী পাখি ছিল, যা এখন নেমে এসেছে ২০-৩০ প্রজাতিতে। অবৈধ জাল, রাস্তা-বাঁধ নির্মাণ ও রাসায়নিক ব্যবহারে এ বিল দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, 'চলনবিলকে যদি ‘Ramsar Wetland Site’ হিসেবে ঘোষণা করা যায়, তবে আন্তর্জাতিক সুরক্ষার আওতায় আনা সম্ভব।'
চলনবিল কেবল একটি জলাভূমি নয়- এটি উত্তরাঞ্চলের প্রাণ, সংস্কৃতি ও জীবিকার প্রতীক। কয়েক লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সরাসরি এই বিলের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু অবাধ দখল, দূষণ ও শিকার চলতে থাকলে অচিরেই এটি হারাবে তার অস্তিত্ব।
স্থানীয়রা বলেন, চলনবিল বাঁচলে বাঁচবে মানুষও। এখন প্রয়োজন সরকারের কঠোর পদক্ষেপ, জনসচেতনতা এবং সম্মিলিত আন্দোলন- “বিল বাঁচাও, প্রাণ বাঁচাও” এখন আর কেবল স্লোগান নয়, এটি টিকে থাকার লড়াই।
এমএ/এমএ