মালয়েশিয়ার রাজধানী পুত্রজায়ায় আজ (মঙ্গলবার) মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে বিভিন্ন সমঝোতা স্মারকের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন শিগগিরই স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে বাংলাদেশী শ্রমিকরা মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ পাবেন। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এবারের আলোচনায় কর্মীদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অভিবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে দুই দেশের সরকার প্রধান একমত হয়েছেন।
মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে পুত্রজায়ায় বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিরাপদ অভিবাসন বিষয়ে দুই দফায় সভা হয়েছে। ওইসব সভা থেকে শ্রমিক প্রেরণের বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ইতোমধ্যে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে বিদ্যমান আইন ও বিধি মেনে মালয়েশিয়ায় কর্মী গমন করলেও উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ের কারণে প্রক্রিয়াটি সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। মালয়েশিয়ার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নেয়া হলেও বিগত সরকারের সময়ে বিপুল সংখ্যক এজেন্সিকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার ফলে অভিবাসন ব্যয় বেড়ে যায়। তবে, কর্মীরা মালয়েশিয়া গিয়ে প্রায় সকলেই কাজ পেয়েছেন এবং নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন, ফলে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। উল্লেখযোগ্য যে, মালয়েশিয়ায় কর্মীদের নূন্যতম বেতন ১,৭০০ রিঙ্গিত, যা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এর ফলে বাংলাদেশী শ্রমিকদের মধ্যে মালয়েশিয়ায় কাজ করার প্রতি আগ্রহ অনেক বেশি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৭-১৮ এবং ২০২২-২৪ মেয়াদে অনলাইন ভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সাড়ে সাত লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন। তাদের সবাই নিয়মিত কাজ এবং বেতন পাচ্ছেন। যদিও কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, তবে মালয়েশিয়া সরকার জানিয়েছে, অভিবাসন প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের নিয়মবহির্ভূত কার্যক্রম হয়নি। দেশের অভ্যন্তরের সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থার দীর্ঘ তদন্তের পর আদালতে রিপোর্ট দেয়া হয়েছে, যেখানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
দেশের অভ্যন্তরের কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির নেতিবাচক প্রচারণা এবং আন্দোলনের কারণে মালয়েশিয়া সরকার কিছুটা বিব্রত হলেও তারা নতুন করে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে দ্বিধান্বিত ছিল। তবে, মঙ্গলবারের এই শীর্ষ বৈঠকটি আশার আলো দেখিয়েছে।
এবারের আলোচনায় শ্রমিকদের সুরক্ষা, নিরাপদ অভিবাসন, এবং স্বল্প ব্যয়ে লাভজনক কর্মসংস্থানের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, যখনই দু’দেশের মধ্যে বাংলাদেশী কর্মীদের মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তখনই কিছু স্বার্থান্বেষী মহল আন্দোলন ও অপপ্রচার চালিয়ে প্রক্রিয়াটিকে বাধাগ্রস্ত করে। কিন্তু এবারের আলোচনায় সরকার প্রধানরা অভিবাসন প্রক্রিয়াকে কর্মীদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তাসহ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের বিষয়ে একমত হয়েছেন।
অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা জানান, সৌদি আরবের পর মালয়েশিয়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় ১০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশী কর্মী কর্মরত। তাদের বেতন-ভাতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় অনেক ভালো। তবে, দেশের অভ্যন্তরে কিছু এজেন্সি, প্রতিযোগী দেশ, এবং তাদের স্বার্থে কাজ করা ব্যক্তিরা বাংলাদেশের এবং কর্মীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের প্রচারণা চালিয়ে আসছে।
তারা আরও জানান, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, এবং শ্রমিকদের কল্যাণ নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা চলমান রয়েছে। ঠিক এমন সময় কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বাংলাদেশী শ্রমিকদের শোষণ ও নির্যাতন নিয়ে নেতিবাচক রিপোর্ট করছে।
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্ট একজন ব্যবসায়ী জানান, কথিত অভিবাসী কর্মীদের বিষয়ে অভিজ্ঞ বলে পরিচিত অ্যান্ডি হাল এবং বাংলাদেশের অভিবাসন বিষয়ক গবেষক রহমান নামক ব্যক্তি বাংলাদেশী কর্মীদের দাসত্বের শৃঙ্খল চলমান থাকার ইঙ্গিত দিয়ে মারাত্মক ধরনের নেতিবাচক রিপোর্ট করেছেন। তবে, মালয়েশিয়ায় বর্তমানে কর্মরত এক মিলিয়ন কর্মীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক মিলিয়ন পরিবার সরাসরি উপকৃত হচ্ছে, এবং প্রতি বছর গড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইতোমধ্যে পুরানো কর্মীরা দেশে ফিরে আসছেন, নতুন কর্মীরা মালয়েশিয়া যাচ্ছেন।
সমালোচনাকারীরা এই বিপুল সংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থানের বিকল্প ব্যবস্থা বা অসচ্ছল পরিবারগুলোর জন্য কর্মসংস্থান করতে কখনোই সক্ষম হবেন না। তাই, সমালোচনা অবসান ঘটিয়ে এই শীর্ষ বৈঠকে নতুন কর্মীদের জন্য সম্মানজনক এবং স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া, এবং তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। নতুন কর্মীদের জন্য বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে মালয়েশিয়ায়। এছাড়া, ইতোমধ্যে ভিসা পাওয়া প্রায় আট হাজার কর্মী, যারা নির্ধারিত সময়ে মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি, তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, আগামী ছয় বছরে মালয়েশিয়ায় কমপক্ষে ১২ লাখ বা তারও বেশি শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে। তারা আশা করছেন, দু'দেশের সরকার প্রধানদের শীর্ষ বৈঠকের পর সকল জটিলতা কেটে যাবে এবং শিগগিরই বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়ার বাজার খুলে যাবে। তাই, বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হলো শ্রমিকদের স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে নিরাপদ কর্মসংস্থান তৈরি করা।
আরএন