রাজশাহীর আমের মোকামগুলোতে এখনও বহাল রয়েছে ‘ঢলন’ প্রথা। আড়তদাররা চাষিদের কাছ থেকে বাড়তি ওজন নিচ্ছেন ঢলন হিসেবে। অর্থাৎ, ৪০ কেজি (এক মণ) আমের দাম দিয়ে তারা নিচ্ছেন ৪৫ থেকে ৫০ কেজি। অথচ গত বুধবার রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে দিনব্যাপী আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এবার রাজশাহী অঞ্চলে আম কেনাবেচা হবে কেজি দরে—কেউ ঢলন নেবেন না। তবে আড়তদাররা কেজিপ্রতি দেড় টাকা কমিশন নিতে পারবেন। কিন্তু একদিন না যেতেই মাঠপর্যায়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে।
জানা যায়, ওইদিন রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁ জেলার চাষি, ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের নিয়ে আয়োজিত বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে ঢলন প্রথা বাতিল এবং কেজিপ্রতি দেড় টাকা বা এক মণে ৬০ টাকা কমিশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু গত শুক্রবার রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আম মোকাম বানেশ্বরে গিয়ে দেখা গেল, সবই চলছে আগের মতো। এখনও ঢলন অনুযায়ী আম বিক্রি হচ্ছে।
বানেশ্বর কাচারি মাঠে কথা হয় স্থানীয় চাষি ও ব্যবসায়ী মো. আবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, “৪০ মণ আম বিক্রি করলাম, কিন্তু প্রতি মণে ৪৫ কেজি গুনতে হলো। কেজি দরের নিয়ম কেউ মানছে না।” পাশেই থাকা আরেক চাষি আজমল হক বলেন, “আগের সিস্টেমেই সব চলছে। কেউ ৪৮ কেজি মণ ধরছে, কেউ ৫২ কেজি। কে কী মানবে, সেটা একেকজনের মতো। কেউ কেজি ধরে নিচ্ছে না।”
বানেশ্বরের ‘নাসিম ফল ভান্ডার’ নামে এক আড়তে গিয়ে মালিককে না পেয়ে কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা হয়। কেজি দরে বিক্রির প্রসঙ্গ তুলতেই একজন সোজা বলে দেন, “এই নিয়ম আমরা মানি না।”
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বানেশ্বর বণিক সমিতির সভাপতি ওসমান আলী। তিনি বলেন, “সিদ্ধান্ত হয়েছিল কেজি দরে আম বিক্রির। ব্যবসায়ীদের স্বাক্ষরও নেওয়া হয়েছে। এমনকি নিয়ম মানাতে বাজারে মাইকিংও করা হয়েছে। তারপরও কেউ মানছেন না। এ অবস্থায় জোর দিলে তারা আম কেনা বন্ধ করে দিতে পারেন, আর তখন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন চাষিরাই।”
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসায়ী শহিদ মিয়া, যিনি দেশের সবচেয়ে বড় আম মোকাম কানসাটে ব্যবসা করেন, বলেন, “সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কেউ কোনো নিয়ম মানছে না, যে যার মতো চালাচ্ছে।”
রাজশাহী অঞ্চলে বহু বছর ধরে এক মণ আম মানে কেউ ধরতেন ৪২ কেজি, কেউবা ৫২ কেজি। কিন্তু দাম ঠিকই দেওয়া হতো ৪০ কেজির হিসেবে। বারবার এই অনিয়ম বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া হলেও কার্যকর ফল মেলেনি। এ প্রেক্ষাপটে গত ২৮ এপ্রিল বিভাগীয় উন্নয়ন সমন্বয় সভায় কেজি দরে কেনাবেচার বিষয়ে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কৃষি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনার জন্য চিঠিও পাঠানো হয়। তবে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না আসায় ৪ জুন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে ফের বৈঠকে বসেন চাষি, ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা।
তাদের দাবি, রাজশাহী বিভাগের সব জেলায় যেন একক নিয়মে আম কেনাবেচা হয়। পরদিন বিভাগের চার জেলার (রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ) হাট ইজারাদার, আড়তদার, ব্যবসায়ী ও চাষিদের নিয়ে আবারও বৈঠক হয়। এতে সিদ্ধান্ত হয়, কেজি দরে আম কেনাবেচা হবে এবং কোনো পর্যায়ে অতিরিক্ত কমিশন নেওয়া যাবে না।
তবে সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার আগেই মাঠে তৈরি হয় জটিলতা। অনেক আড়তদারই কেজিপ্রতি ৩ টাকা কমিশন দাবি করতে শুরু করেন। কিছু জায়গায় চাষিরা বাধ্য হয়ে এই হার মেনে নিয়েছেন।
এই অবস্থার নিরসনে গত বুধবার সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিভাগীয় কমিশনার আবার বৈঠকে বসেন বানেশ্বর, কানসাট, ভোলাহাট, রহনপুর ও সাপাহারের আম মোকামের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। কিন্তু এত দীর্ঘ আলোচনার পর গৃহীত সিদ্ধান্তও বাস্তবে কার্যকর হলো না।
বানেশ্বর আমের হাট নিয়ে ওই দিন পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একেএম নূর হোসেন নির্ঝর বলেছিলেন, “সভায় যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তা আমরা বাস্তবায়ন করব।” তবে একই নিয়মে আম কেনাবেচা হচ্ছে কি না জানতে শনিবার তাকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গেও মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সাড়া মেলেনি।
আরএইচ/এমআর