প্রকৃতির সবুজ চাদরে ঢাকা নৈস্বর্গিক শোভামন্ডিত শেরপুরের সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলার গারো পাহাড়ে পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে নির্মাণাধীন দাওধারা গারো পাহাড় পর্যটন কেন্দ্রটি। জেলায় যে দুটি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে সেগুলোর চেয়ে এই স্থানের উচু নিচু লাল পাহাড়ে বেষ্টিত সবুজ গাছগাছালির নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে ভ্রমণ পিয়াসীরা উচ্ছসিত ও আনন্দিত হবেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।
তাই পর্যটন শিল্প বিকাশে এর স্থগিত হওয়া নির্মাণ কাজ দ্রুত শুরু করার জোড় দাবি জানান তারা।
জানা গেছে, মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো চিত্তবিনোদন। এই চাহিদা পূরণ, দেশের পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধকরণ ও সরকারি রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে এই পর্যটন কেন্দ্রটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। সে লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ওই পর্যটন কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। প্রধান গেট নির্মাণ করে চলাচলের জন্য ইটের সলিং শুরু করা হয়েছিল।
এদিকে, বন বিভাগ শুরু থেকেই এই নতুন পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছিল।
তাদের দাবি, এখানে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করা হলে বন্যহাতি চলাচলের সমস্যা সৃষ্টি হবে। এমনকি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। সে কারণে এর নির্মাণ কাজ স্থগিত করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে অতি সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শামিমা বেগম সরেজমিনে পরিদর্শন করে গেছেন। এই প্রতিবেদন তৈরি করা পর্যন্ত বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি।
তবে এলাকাবাসী বলছেন, প্রায় দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে গারো পাহাড়ে বন্যহাতি আনাগোনা করছে। তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বরং তারা আরও গারো পাহাড়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া পর্যটন কেন্দ্রের জন্য মনোনীত স্থানের আশপাশে আরও শত শত হেক্টর বনভূমি রয়েছে। ওই স্থান দিয়ে বন্যহাতি অবাধে চলাচল করে। মনোনীত স্থানে পর্যটন কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হলে বন্যহাতির চলাচলে কোনো সমস্যা হবে না। বিনোদনের পাশাপাশি এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
এই পর্যটন কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হলে একদিকে পর্যটকরা বিনোদন পাবে। পাশাপাশি সরকার এই পর্যটন কেন্দ্র থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে পারবে। মোটকথা রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস হবে এটি।
জানা গেছে, সরকারি নির্দেশনায় দেশের পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ ও রাজস্ব বৃদ্ধি করতে নতুন বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। এরই প্রেক্ষিতে নালিতাবাড়ী উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের দাওধারা কাটাবাড়ির পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ২২০ একর ৭৭ একর পাহাড়ি বনভূমি নিয়ে নতুন একটি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্থান নির্বাচন করে ২০২৩ সালের ০৫ এপ্রিল তৎকালীন জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার ওই স্থানে নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একইসঙ্গে ওই পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়ার রাস্তায় মাটি কাটার কাজ, গেইট নির্মাণ ও আনুষাঙ্গিক কিছু কাজ করা হয়।
দাওধারা গ্রামের বাসিন্দা হোসেন আলী বলেন, 'গারো পাহাড়ে দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে শতাধিক বন্যহাতির বিচরণ রয়েছে। এরা বছরজুড়ে গারো পাহাড়ে আনাগোনা করে থাকে। এদের চলাচলের জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পথ।'
নুরুল হোসেন বলেন, 'নির্মাণাধীন পর্যটন কেন্দ্র ছাড়াও জেলায় গজনী অবকাশ কেন্দ্র ও মধুটিলা ইকোপার্ক রয়েছে। বন্যহাতির দল পর্যটন কেন্দ্র দুটির কোনো ক্ষতি করে না। বরং বাস্তবে বন্যহাতি দেখে পর্যটকরা আরও আনন্দিত ও পুলকিত হন। এখানে নতুন আরেকটি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভ্রমণ পিপাসুরা ছুটে আসবেন। এতে একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব পাবে অন্যদিকে স্থানীয়দের জন্য সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান।'
হারেজ আলী বলেন, 'বন্যহাতি দেখার জন্য অনেক মানুষ ছুটে আসে গারো পাহাড়ে। তাছাড়া পূর্ব দিকে আছে নাকুগাঁও স্থলবন্দর ও পশ্চিম দিকে আছে মধুটিলা ইকোপার্ক। এর মাঝখানে দাওধারা গারো পাহাড়। এখানকার মানুষের তেমন কোনো কর্মসংস্থান নেই। তাই এখানে যদি নতুন পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হয় তাহলে এখানকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বন্যহাতির জন্য পর্যটন স্থাপনের কাজ বন্ধ হতে পারে না। হাতির চলাচলও ঠিক রাখতে হবে। একইসঙ্গে বিনোদন ও মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের বিষয়টিও ভাবতে হবে।'
দাওধারা গ্রামের অপর বাসিন্দা রাশিদা বেগম বলেন, 'আমরা গরীব মানুষ আমাদের চলার কোনো পথ নেই। আমরা এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন থেকে লাকড়ি কুড়িয়ে বিক্রি করে কষ্ট করে সংসার চালাই। দাওধারা গারো পাহাড়ে যদি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হয় তাহলে আমরা অন্তত পানি বিক্রি করে হলেও আমাদের সংসার চালাতে পারবো। তাই সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি, চিত্তবিনোদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে দাওধারা গারো পাহাড় পর্যটন কেন্দ্রটির স্থগিত করা কাজ দ্রুত শুরু করা দরকার।'
ময়মনসিংহ বন বিভাগের মধুটিলা ফরেস্ট রেঞ্জকর্মকর্তা দেওয়ান আলী বলেন, 'পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শামিমা বেগম নির্মাণাধীন দাওধারা গারো পাহাড় পর্যটন কেন্দ্রটির অবস্থান ও পরিবেশসহ সার্বিক বিষয় সরেজমিনে পরিদর্শন করে গেছেন। তার নির্দেশনা পেলে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।'
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা আক্তার ববি বলেন, 'দাওধারা গারো পাহাড়ে ২২০ দশমিক ৭৭ একর খাস জমি উদ্ধার করে নতুন পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের কাজটি আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। পরিবেশের সঙ্গে মিল রেখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।'
এমএস/এমএ