দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জেলা প্রশাসকদের সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
রোববার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলন ২০২৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
ড. ইউনূস বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বা শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা মস্ত বড় ইস্যু। এটা আমাদের এখন এক নম্বর বিবেচ্য বিষয়। এখানে যেন আমরা বিফল না হই, কারণ এটাতেই আমাদের সমস্ত অর্জন।’
সকল নাগরিকের সুরক্ষা বিধান করা সরকারের দায়িত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন থেকে যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করবো, সেখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা ও দেশের সকল মানুষকে সুরক্ষা প্রদান করা। নারী ও শিশু এবং সংখ্যালঘুসহ সকল নাগরিকের সুরক্ষা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। কে কোন মতবাদে বা রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী সেটা বিবেচ্য নয়। কারণ সরকার দেশের সকল মানুষের সরকার। তাই তাকে সুরক্ষা দেওয়া আমার কাজ।’
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার যেন ক্ষুন্ন না হয় সে দিকে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে সজাগ থাকার নির্দেশ দেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়া মস্ত বড় দায়িত্ব। এই ইস্যুতে সারা দুনিয়া নজর রাখছে আমাদের উপরে। একটা ছোট্ট ঘটনা সারা দুনিয়ায় চাউর হয়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বলেছি আপনারা সংখ্যালঘু হিসেবে কোনো কিছু দাবি করবেন না, দেশের নাগরিক হিসেবে দাবি করবেন। কারণ দেশের নাগরিক হিসেবে সংবিধান আপনাকে যে অধিকার দিয়েছে সেই অধিকার রাষ্ট্রের কাছে আপনার প্রাপ্য। এটা দাবি নয়, আপনার পাওনা।’
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাজার দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এটা নিয়ে জেলা প্রশাসকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতে পারে কার জেলায় বাজার দর কতটা ভালো নিয়ন্ত্রণে আছে। কোনো চাঁদাবাজি বা অন্য যেসব অসুবিধা থাকে সেগুলো দূর করতে হবে।’
পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগবে না, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
প্রধান উপদেষ্টা সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে এখন যে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগছে না, এই তথ্য মাঠে-ঘাটে জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি হয়, এটি বন্ধ করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম সনদের মত পাসপোর্ট পাওয়া প্রতিটি মানুষের অধিকার।’
সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি করার আহ্বান জানিয়ে জেলা প্রশাসকদের তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে সৃজনশীল কাজ করার সুযোগ তোমাদের পুরো মাত্রায় রয়েছে। আশা করি তোমরা সেটা গ্রহণ করবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, বাজার দর নিয়ন্ত্রণ, জমির রেকর্ড পত্র থেকে শুরু করে অন্যান্য সেবা অনলাইনে প্রদান, প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধিসহ সরকারি সেবাকে জনবান্ধব করার ক্ষেত্রে সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে সুস্থ প্রতিযোগিতা হতে পারে।’
জন্ম সনদ একজন নাগরিকের অবশ্যই প্রাপ্য উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘যেকোনো বয়সে এবং যেকোনো সময়ে একজন নাগরিক জন্ম সনদ চাইতে পারে। তাকে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জন্ম সনদ একজন নাগরিকের দালিলিক প্রমাণ যে ওই ব্যক্তি এই দেশের নাগরিক। কারণ এই জন্ম সনদ দিয়েই তার অন্যান্য কাজ করতে হবে। এটা না হলে জাতীয় পরিচয়পত্র হচ্ছে না, পাসপোর্ট হচ্ছে না। জন্ম সনদ পেতে একজন হয়রানির শিকার হচ্ছে কি না সেটা দেখতে হবে।’
সরকারকে একটা ‘খেলার টিম’ অভিহিত করে জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সরকারকে যদি একটা ক্রিকেট বা ফুটবল টিমের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে এটা একটি টিম। এই সরকারের ছয় মাস চলে গেলো, এটাকে আমি বলছি সরকারের প্রথম পর্ব।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রথম পর্বের কোনো ভুল থাকলে সেটাকে ঠিকঠাক করে এখন আমরা খেলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এখন কাজ হলো কর্মপদ্ধতি ঠিক করা। খেলা হলো একটা সামগ্রিক বিষয়, একজনের ভুলের কারণে অন্যরা সাফল্য থেকে বঞ্চিত হয়। পুরো টিমের সাফল্যটা গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। প্রস্তুতির কোথাও ঘাটতি থাকলে সেটাকে পূরণ করা দরকার।’
জেলা প্রশাসকদের ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে নিজের মতো করে মাঠ প্রশাসন পরিচালনা করার আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস। একইসঙ্গে সরকারপ্রধান বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অহেতুক স্তুতি বা প্রশংসা করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম ও পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক ছাবেদ আলী বক্তব্য রাখেন। বাসস।
এমএ