রংপুরে খবর প্রকাশের জেরে দৈনিক সংবাদ, একুশে টেলিভিশন ও বাংলা ট্রিবিউনের সিনিয়র সাংবাদিক লিয়াকত আলী বাদলকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে সিটি করপোরেশনের সিও’র রুমের সামনে নিয়ে মারধোর, হেনস্তা এবং জোর করে ক্ষমা চাওয়ানোর চেষ্টায় তোলপাড় চলছে। ঘটনার সাথে জড়িতরা জুলাই যোদ্ধার নামে সিটি করপোরেশনে অটো রিকশার লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারী। এ ঘটনায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে জড়িতদের গ্রেফতার এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে সাংবাদিকরা।
জানা যায়, গত ১৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংবাদে ‘রংপুরে জুলাই যোদ্ধাদের নামে অটো রিকশার লাইসেন্স, ৫ কোটি টাকা বাণিজ্যের পায়ঁতারা’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়। এই খবর প্রকাশের জেরে রোববার বেলা সাড়ে ১১ টায় নগরীর কোর্ট মসজিদ এলাকা থেকে সাংবাদিক লিয়াকত আলী বাদলকে রকি নামের এক যুবকের নেতৃত্বে ৭/৮ জন যুবক জুলাই যোদ্ধা পরিচয়ে অটোতে করে সিটি করপোরেশনের প্রধান ফটকে নিয়ে যায়। সেখানে থেকে তাকে টেনে হিচরে নতুন ভবনের দোতালায় প্রধান নির্বাহীর রুমের সামনে নিয়ে যায়। এবং তাকে নিউজের জন্য প্রধান নির্বাহীর কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। তখন প্রধান নির্বাহী তার কক্ষে উপস্থিত ছিলেন না।
সংবাদ পেয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করেন। তাৎক্ষণিকভাবে নতুন ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন সাংবাদিকরা। এসময় ঘটনার বর্ণনা দেন ভূক্তেভোগি সাংবাদিক রংপুর সম্মিলিত সাংবাদিক সমাজের সদস্য সচিব লিয়াকত আলী বাদল।
বক্তব্য রাখেন রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন-আরপিউজের সভাপতি সালেকুজ্জামান সালেক, রংপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মাহবুব রহমান, রংপুর রিপোর্টার্স ক্লাব ও রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন-আরপিউজের সাধারণ সম্পাদক সরকার মাজহারুল মান্নান, রিপোর্টার্সর ক্লাব রংপুরের সভাপতি শাহ বায়েজিদ আহমেদ, রংপুর সিটি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির মানিক, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি মমিনুল ইসলাম রিপন, রংপুর রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি শরিফা বেগম শিউলি, টেলিভিশন ক্যামেরা জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম মুকুল, রংপুর অনলাইন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের আহবায়ক ফেরদৌস জয় প্রমুখ।
বক্তারা ২৪ ঘন্টার মধ্যে মারধোরকারীদের গ্রেফতার এবং সিও উম্মে ফাতেমাকে অপসারণের দাবি জানান। একই দাবিতে সোমবার রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ কর্মসূচি দিয়েছে সাংবাদিককরা।
এদিকে অবস্থান কর্মসূচি শেষ করে সাংবাদিকরা চলে আসতে থাকলে সে সময় সিটির করপোরেশনের একজন কর্মকর্তাসহ সিও ঘটনাস্থলে আসলে উত্তেজনা তৈরি হয়। এক পর্যায়ে সাম্প্রতিক সময়ে নিয়োগ পাওয়া আওয়ামী লীগের কয়েকজন চিহ্নিত কর্মচারী আবারও সাংবাদিকদের হেনস্তা করার চেষ্টা করেন। তাদেরকে সিটি করপোরেশনের ভেতরে আটকে রাখেন। প্রধান ফটক বন্ধ করে দেন। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে সাংবাদিকররা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গোটা শহরে তোলপাড় সৃষ্টি হলে সাংবাদিকদের নিয়ে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে বৈঠকে বসে রংপুরে বিদ্যমান সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ ছাড়াও প্রায় দেড় শতাধিক সাংবাদিক। এসময় ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন ভুক্তভোগি সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ।
এসময় সাংবাদিকনেতারা বলেন, কার নির্দেশে সাংবাদিক লিয়াকত আলী বাদলকে অপহরণ করে নিয়ে যায় জুলাই যোদ্ধাদের নামে। তাদেরকে গ্রেফতার এবং যাদের নির্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদেরকেও গ্রেফতার করতে হবে। একই সাথে আবেদনকারীর সবার নাম পরিচয়সহ প্রকাশ করতে হবে। যারা হামলা ও অপহরণের সাথে জড়িত তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে হবে। একই সাথে সাংবাদিকদের কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর সিটি করপোরেশনের যেসব কর্মকর্তা কর্মচারী সাংবাদিকদের আটকিয়ে হেনস্তা করেন তাদের বরখাস্ত করতে হবে। এছাড়াও ঘটনার সময় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কেন সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের নিবৃত করলেন না, সেটিও তদন্ত করতে হবে।
এসময় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মহানগর আহবায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতি ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে নিন্দা জানান এবং জড়িতদের ব্যপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করেন।
এসময় রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও রংপুর প্রেসক্লাবের প্রশাসক রমিজ আলম বলেন, এ ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃজনক। এটার জন্য আমরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একই সাথে যারা এ ঘটনার সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পরে সেখানে উপস্থিত সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী উম্মে ফাতেমা ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এঘটনায় জড়িতদের ব্যাপারে তদন্ত হবে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যারা জড়িত তাদের ব্যপারেও যথাযথভাবে আপনারা নিউজ করবেন। এসময় তিনি দ্বিতীয় দফায় সাংবাদিকদের হেনস্তাকারী সিটি করপোরেশনের জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান।
রংপুর মহানগর পুলিশের ডিসি ক্রাইম মারুফ আহমেদ জানান, এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যাদের নির্দেশে এই ঘটনা ঘটেছে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
এলওয়াই/এসআর